গভীর রাতে বাসায় ঢুকে ইউএনওর ওপর হামলা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

গভীর রাতে বাসায় ঢুকে ইউএনওর ওপর হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা এবং দিনাজপুর ও চিরিরবন্দর প্রতিনিধি : গভীর রাতে বাসায় ঢুকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হামলায় তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখও গুরুতর আহত হয়েছেন। বুধবার রাত ৩টার দিকে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে এ হামলার ঘটনা ঘটে। আঘাতে ওয়াহিদার খুলির হাড় ভেঙে মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয় ওয়াহিদা খানমের। দুই ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে তাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তার সেরে ওঠার বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা। তার সর্বোচ্চ চিকিৎসা
নিশ্চিতের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নৃশংস এ হামলার কারণ তাৎক্ষণিক জানা না গেলেও মাদকবিরোধী অভিযান, কোনো শত্রুতা এমনকি ডাকাতির মতো বিষয়ও সন্দেহ করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় ইউএনওকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রতিমন্ত্রী এবং জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। এ সময় ইউএনও প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেন। হামলার ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার।
গতকাল সকালে বাসা থেকে ওয়াহিদা ও তার বাবাকে উদ্ধারের পর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। সেখানে ইউএনওর অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনা হয়। তার বাবাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ঘটনার পর গতকাল সচিবালয়ে তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিং করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, ইউএনওর বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দুজন মুখোশধারীকে বাসায় ঢুকতে দেখা গেছে। তাদের পরিচয় জানতে পুলিশ কাজ করছে। কী উদ্দেশ্যে হামলা তা জানতে কাজ চলছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, শত্রুতাবশত মনে হচ্ছে না। ডাকাতির উদ্দেশ্য বা এ রকম কিছুও হতে পারে।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটিতে সদস্যরা হলেন রংপুর ডিআইজির একজন প্রতিনিধি এবং দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ মাহমুদ।

ঘোড়াঘাট থানার ওসি আমিরুল ইসলাম জানান, ধারণা করা হচ্ছে রাত ৩টার দিকে ইউএনওর বাসভবনের দোতলার বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে ভেতরে ঢুকে হামলাকারীরা। ঘটনাস্থলের নিচে একটি মই পাওয়া গেছে। প্রথমে ইউএনওর বাবাকে আহত করে বাথরুমে আটকে রাখে। এর পর ইউএনওকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। বাসভবনের নাইট গার্ডকে নিচতলার একটি ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখে। কাজের মেয়েও নিচতলায় ছিল। ওসি বলেন, দুষ্কৃতকারীরা ১/২ জন হতে পারে। এটি কোনো ডাকাতির ঘটনা ছিল না। সম্ভবত ইউএনওকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল।
স্থানীয়রা জানান, ইউএনওর বাবা ওমর আলী প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হন। গতকাল তিনি বের হননি। এতে তার হাঁটার সঙ্গীরা খোঁজ নিতে বাসায় যান। সেখানে সাড়া না পেয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
ওমর আলী ঘোড়াঘাটে মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। ওয়াহিদার স্বামী মেজবাহুল হোসেন রংপুরের পীরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বিসিএস (প্রশাসন) ৩১ ব্যাচের ওয়াহিদা খানম সহকারী কমিশনার হিসেবে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি দিনাজপুর কালেক্টরেটে যোগ দেন। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান। তার বাড়ি নাটোরে এবং শ্বশুরবাড়ি নওগাঁয়। আদিত নামে তার তিন বছরের একটি সন্তান রয়েছে।
দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলম বলেন, ইউএনওকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এমনটিই মনে হচ্ছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা হচ্ছে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ইউএনও ওয়াহিদা খানমের মাথায় আঘাতের কারণে হাড় ভেঙে সেটা মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। তার শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে আছে। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ইউএনওর মাথার আঘাত অনেক জটিল ও গুরুতর বলেও জানান তিনি।
হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ইউএনওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মাথার খুলির হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। এটি মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে প্রচ-ভাবে। ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার অবস্থা স্থিতিশীল নয়। ব্লাড প্রেশার কমে গেছে। জ্ঞানের মাত্রা সাধারণ মানুষের মতো নেই; যদিও তিনি কথা বলার চেষ্টা করছেন। তিনি প্রেশার ধরে রাখতে পারছেন না। প্রেশার কমে গেছে। পালস বেড়ে গেছে। তিনি রেস্টলেস অবস্থায় আছেন। আগে তাকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে হবে। অপারেশন করার মতো অবস্থা নেই। এখন অপারেশন করলে বিপজ্জনক হবে। আগে তার অবস্থার উন্নতি করাতে হবে। ব্লাড ও স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ওষুধ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান তোফায়েল আহমেদ ভূঁইয়া জানান, ইউএনওর মাথার বাম পাশের আঘাত গুরুতর। সেখানটা দেবে গেছে। ডান হাত ও পা অবশ হয়ে গেছে। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ভারত সীমান্তবর্তী দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মাদকের বেচাকেনা হয়। ওয়াহিদা খানম ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাদকপ্রবণ এলাকাগুলোতে অভিযান চালিয়েছেন। মাদক চোরাচালানিরা হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে কিনা এমন আলোচনা করছেন কেউ কেউ।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাশ ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের জানান, তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না। এ ঘটনায় ইউএনওর বাসভবনের প্রহরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম, জেলা পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন।

রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াহাব ভূঁইয়া বলেন, এখনো হামলার কারণ জানা যায়নি। হামলায় কে বা কারা জড়িত তা তদন্তের পর জানা যাবে।
সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারা এ হামলা চালিয়েছে, তা খুব দ্রুত জানা যাবে। তিনি বলেন, ইউএনওর বাসায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে। যে দুজন দুর্বৃত্তকে ঢুকতে দেখা গেছে তাদের মুখে মুখোশ ছিল এবং সেগুলো দেখে পর্যালোচনা চলছে। ওখানে হাই পাওয়ার্ড টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, পুলিশের চৌকস একটি টিম কাজ করছে। তারা আশাবাদী যে খুব দ্রুত আমাদের জানাতে পারবেন কারা এ ঘটনাটা ঘটিয়েছে, আমরা অপেক্ষা করছি।

ইউএনওর চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল সব থেকে ভালো। প্রতিমন্ত্রী বলেন, শত্রুতাবশত করলে ইউএনও একা আক্রান্ত হতেন, কিন্তু তার বাবাও আক্রান্ত হয়েছেন। ডাকাতির উদ্দেশ্যে বা এ রকম কিছুও হতে পারে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আশা করি জটটা খুলবে এবং আমরা অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে ফরহাদ হোসেন বলেন, পারিবারিক শত্রুতা মনে হচ্ছে না, তবে তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আমরা জিজ্ঞেস করেছি, কোনোকিছু খোয়া গেছে কিনা, এখনো জানা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি ডিসিকে জিজ্ঞেস করেছি শত্রুতাবশত এ রকম কিছু হয়েছিল কিনা? তিনি বলেছেন, এ ধরনের কোনো কিছু ইউএনও তাকে কখনো অবহিত করেননি। জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

Comment here