ঘুরে দাঁড়ানোই এখন নারী উদ্যোক্তার বড় চ্যালেঞ্জ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ঘুরে দাঁড়ানোই এখন নারী উদ্যোক্তার বড় চ্যালেঞ্জ

লাবণ্য লিপি ; ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ^।’ এটা হচ্ছে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সেøাগান। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ^ নারী দিবস। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর নারীর উন্নয়নের অন্যতম শর্ত নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে দেশের নারী উদ্যোক্তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ সংকট কাটিয়ে ওঠা এখন তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংকট কাটিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চাই যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা।

এ করোনাকালে ই-কমার্সের আন্ডারে কাজ করছেন প্রায় সাড়ে চার লাখ অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা। বললেন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে সংগঠন উই-এর (উইম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং ই-ক্যাবের (ই- কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা। তিনি বলেন, ফেসবুক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রায় ৫০ হাজারের মতো পেজ ছিল উদ্যোক্তাদের, যার মধ্যে ৪০ হাজারই ছিল নারী উদ্যোক্তাদের।

করোনাকালে এ উদ্যোক্তাদের সংখ্যাই বেড়ে দাঁড়াল সাড়ে চার লাখে। বলতে দ্বিধা নেই, এদের বেশিরভাগ এসেছেন প্রয়োজনের তাগিদে। তখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং সংসার চালানোর জন্য তাদের উপার্জন করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন বলেই কাজ শুরু করেন। এদের বেশিরভাগই কিন্তু শুরু করেছিলেন অত্যন্ত স্বল্প পুঁজিতে। আমরা যখন উই থেকে ঘোষণা দিলাম সবাই দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করব। অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। করোনার লকডাউনে তো প্রায় সব উদ্যোক্তার বিনিয়োগ আটকে গিয়েছিল। তখন সামনে পয়লা বৈশাখ। ফেব্রুয়ারি থেকেই সবাই প্রোডাক্ট স্টক করতে শুরু করেছিল।

মার্চের শেষ দিকে লকডাউন দেওয়ায় সবার প্রোডাক্ট আটকে গেল। এর পর সরকার থেকে যখন হোম ডেলিভারি দেওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল তখনই আমরা তাদের নিয়ে নানা রকম ওয়ার্কশপ করে অনলাইন সেল বাড়াতে চেষ্টা করি। গর্বের সঙ্গে বলছি মাত্র তিন মাসেই

আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে লাখপতির সংখ্যা হয়ে গেল প্রায় ৫০০ জনের মতো। আর মিলিনিয়র হলো ১০ জনের মতো। শুনে অবাক হবেন এদের মধ্যে একজন ইলিশ মাছ বিক্রি করে মিলিনিয়র হয়েছেন। এদের কেউ কিন্তু সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পাননি। তার কারণ তাদের তেমন কাগজপত্র নেই। তারা মূলত ফেসবুকে পেজ খুলেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন আমরা তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নানা রকম অয়ার্কশপের আয়োজন করছি। আমরা চেষ্টা করছি দেশীয় নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্য দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে দিতে। সেই লক্ষ্যেই আমরা উই-এর শাখা জাপান, ভারত, নেপালেও করছি। আজ নারী দিবস থেকে উই-এর জাপান ডোর ওপেন হয়ে যাচ্ছে। আশা করি এটা উদ্যোক্তাদের জন্য একটা বড় সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করবে।

নারী উদ্যোক্তারা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কাজ করছেন। এর মধ্যে পোশাকশিল্প, সৌন্দর্যসেবা, খাবার, প্রসাধনসামগ্রী, নিত্যব্যবহার্য জিনিস ইত্যাদিই প্রধান। করোনাকালে অতি সংকটাপন্ন সেক্টরের মধ্যে সৌন্দর্যসেবা খাত অন্যতম। কেননা এ খাতে গ্রাহককে সরাসরি হাতের সংস্পর্শে সেবা দিতে হয়। তাই লকডাউনে এ সেক্টরটা মোটামুটি বন্ধই ছিল বলা চলে। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা শুরু করলেও অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ে যায় বিপাকে।

অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লকডাউনের সময়ই তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এতে শুধু উদ্যোক্তা নয়, কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন অনেক কর্মীও। এ খাতে উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করছে বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বলা। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এ সেক্টরে পুরনোদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি।

করোনার লকডাউনের সময় এ খাতের উদ্যোক্তারাও অত্যন্ত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। সেই দুঃসময়ে আমরা প্রায় এক হাজার নারীকে নগদ অর্থ সহযোগিতা করেছি শুধু টিকে থাকার জন্য। এখন তারা আবার শুরু করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু শুরু করার জন্য প্রথমেই তাদের দরকার নতুন করে বিনিয়োগ। যার সঙ্গতি অনেক উদ্যোক্তারই নেই। এরা ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে পারে না নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে।

প্রথমত এদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। আবার যে ব্যয়টা দেখিয়ে তারা ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করবে, যেমন : মেশিনারিজ, কাঁচামাল- সেগুলোও ব্যাংকের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আবার সরকার ঘোষিত প্রণোদনা এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য খুব একটা সহায়কও মনে হয় না। কেননা প্রণোদনার ঋণ পাওয়া যাবে এক বছরের জন্য। তার পর ফেরত দিতে হবে। এক বছর ব্যবসা করে সেই টাকা ফেরত দেওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না বলেই আমি মনে করি। সে ক্ষেত্রে এমনিই ব্যাংক ঋণ বরং সহায়ক। সেটা তিন বছরের জন্য দেওয়া হয়। এ খাতের নারী উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে এখন সবার আগে দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সর্বোপরি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাবান্ধব মানসিকতা। মানে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া।

গত বছর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অবগভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে মহামারীর প্রতিঘাত শুরু হলে জুন পর্যন্ত অনলাইন নারী উদ্যোক্তাদের ২৪ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যেসব নারী উদ্যোক্তা প্রসাধন ও ফ্যাশন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তারা বেশি সমস্যায় পড়েছেন। বিশেষ করে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যে সব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা করতেন তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।

শিল্প ও ব্যবসা খাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করে, যার বেশিরভাগই স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্যও সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন যে উদ্যোক্তারা তাদের ট্রেড লাইসেন্স বা নিবন্ধন নেই। ফলে ৬৫ শতাংশ নারী তাদের সঞ্চয় এবং ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা তাদের পরিবার ও বন্ধুদের মধ্য থেকে ঋণ সহায়তা নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন।

সম্প্রতি অনলাইনে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এশীয় নারী উদ্যোক্তা সামিট ২০২১-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীতে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ, প্রশিক্ষণ ও ককারিগরি সহায়তা দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

একই অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, দেশের করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, তাদের এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে হবে। দেশের শতকরা ৯৮ শতাংশের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি। অথচ তাদের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। তাই দেশের অর্থনীতির প্রাণ এসএমই খাতের উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

নারী উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের। মহামারী মোকাবিলায় এ খাতের জন্য সরকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছে যার পুরোটাই ব্যাংকনির্ভর। কিন্তু অনেক ব্যাংকই জামানত ছাড়া ঋণ দিতে চায় না। ফলে ক্ষুদ্র শিল্পে নিয়োজিত নারী উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই এ ঋণ পাননি। এ প্রসঙ্গে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনাকালে যেসব নারী ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই ঋণ নিতে পারছেন না। যেহেতু ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে ক্ষতির পরিমাণ খতিয়ে দেখে ঋণ দিতে, ব্যাংক সে ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে।

এমনিতেও ব্যাংক নারীদের ঋণ দিতে গড়িমসি করে বা নারীদের প্রতি আস্থা রাখতে চায় না। সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের তারা অধিক ঝুঁকিপূর্ণই মনে করছে। অথচ ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার ১ হাজার কোটি টাকা নারীদের দেওয়ার কথা। সরকার তাদের এ আশ^াসও দিয়েছে যে, উদ্যোক্তারা যদি এ ঋণ শোধ করতে না পারে সে ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি স্বরূপ প্রায় ৯০ ভাগ দিয়ে দেবে। তবুও ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের ভালো ক্লায়েন্ট মনে করছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই এ বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় এ ঋণ দিতে পারে। এনজিওর মাধ্যমেও ঋণ বিতরণ করা যেতে পারে।

তবে এনজিওগুলো যেহেতু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেশি গুরুত্ব দেয় সে ক্ষেত্রে মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যাংকের মাধ্যমেই ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর শুধু ঋণ দিলেই হবে না। তাদের বিজনেস রিকোভারি প্রশিক্ষণটাও দিতে হবে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তাদের মূলধারার শিল্পে ফিরিয়ে আনতে পারলেই দেশের অর্থনীতি আরও বেগবান হবে।

 

Comment here