জাপানি হান্নান যেন আরেক সাহেদ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

জাপানি হান্নান যেন আরেক সাহেদ

হাসান আল জাভেদ : রাজনৈতিক টকশোতে আলোচনায় ঝড় তুলতেন দক্ষিণখানের আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান। ছবি তুলতেন রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে। আপলোড করতেন ফেসবুকে। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তোলা সেসব ছবিসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন সাঁটিয়ে স্বল্প সময়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেন। চলতেন শটগান হাতে; সামনে-পেছনে থাকত নিরাপত্তা বহর।

স্থানীয়রা বলছে, একজন ভিআইপির কাছের ছোটভাই পরিচয়ে দক্ষিণখান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আতঙ্কে রাখতেন জাপানি হান্নান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচয়ও দিতেন। পরিচয় দিতেন চাঁদপুরের (মতলব) আসনের সাবেক এমপি নুরুল হুদার আত্মীয় হিসেবে। বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি বরকত উল্লাহ বুলুর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিতেন।

পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছে, একই সঙ্গে আওয়ামী সৈনিক লীগ, ভিআইপির কাছের লোক এবং মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দিলেও জাপানি হান্নান একজন প্রতারক। কারাবন্দি প্রতারক সাহেদের স্টাইলে প্রভাব বিস্তার করে স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজিই ছিল তার নেশা। রাতের আঁধারে স্থানীয় আইনুশবাগ এলাকার সাইবোর্ড উধাও করে নাম দেন গ্রামেরবাড়ি চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে ‘চাঁদনগর কল্যাণ সোসাইটি’। নিজেই হন ওই সংগঠনের সভাপতি। এর পর ওই এলাকার ময়লাবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন।

ময়লাবাণিজ্য এবং চাঁদনগর নামকরণ নিয়ে তার সঙ্গে বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহেল রেজার দ্বন্দ্ব হয়। সোহেল রেজা নিহত বালু ব্যবসায়ী আবদুর রশীদের ঘনিষ্ঠজন। পুরনো দ্বন্দ্ব এবং বালু ব্যবসার চাঁদাবাজি প্রতিহত করতে গিয়ে জাপানি হান্নানের মুখোমুখি হন সোহেল রেজা। তবে গুলি গিয়ে বিদ্ধ হয় আবদুর রশীদের শরীরে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাপানি হান্নান নিজ হাতে গুলি করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল আজিজ বলেন, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আদালতে পাঠানো হয়।

আদালত প্রতিবেদক জানান, আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নানের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অন্যদিকে একই আসামির অস্ত্র মামলায় একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া হত্যা মামলায় অপর সাত আসামির দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মহানগর হাকিম আবু সাঈদ আসামিদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এক সময়ে শ্রমিক হিসেবে জাপানে যান দক্ষিণখান এলাকায় বসবাসের পাশাপাশি গাড়িচালকের চাকরি করা চাঁদপুর মতলব উপজেলার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম। সেখান থেকে ১৫ বছর আগে দেশে ফিরে দক্ষিণখান এলাকায় জমি কিনে বাড়ি নির্মাণসহ জাপানভিত্তিক কয়েকটি কথিত সংগঠন খুলে ফেলেন। ‘জাপান বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা, জাপান ক্লাব, প্রাইড জাপান বাংলাদেশ লিমিটেড, মার্কস স্যোশাল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামক এনজিও, বৃহত্তর কুমিল্লা সোসাইটির নেতা পরিচয় দেন। আওয়ামী সৈনিক লীগ পরিচয়ে সম্পর্ক গড়েন প্রয়াত মন্ত্রী সাহারা খাতুনের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে।

গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে নির্বাচিত সাবেক মন্ত্রী ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ বিশিষ্টজনের নাম ব্যবহার করে এলাকায় প্রভাব বিস্তার কৌশলে টেলিভিশন টকশোতে অংশ নেন। বিশিষ্টজনের সঙ্গে সেলফি তুলে সেসব ছবি দিয়ে এলাকায় ব্যানার সাঁটান। এমনকি দক্ষিণখানের আইনুশবাগের নাম বদলে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে রাতারাতি ‘চাঁদনগর’ হিসেবে সাইনবোর্ড লাগান।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন হাবিব হাসান। এমপির পালাবদলে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন জাপানি হান্নান। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল রেজার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। যে কারণে সোহেল রেজাকে গুলি করতে যান।

দুই বছর আগে ময়লাবাণিজ্য কেন্দ্র করে স্থানীয় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের এক কর্মীর পায়ে গুলি করেন জাপানি হান্নান। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে কারাবরণ করতে হয়নি তাকে।

বিমানবন্দর এলাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের টয়লেট দখল, জাপান ক্লাবের আড়ালে উত্তরায় মদের বার, মার্কস স্যোশাল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামক এনজিও ব্যবহার করে এলাকায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, জাপানি হান্নান আইনুশবাগ এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক পরিচয়ে কথায় কথায় অস্ত্র উঁচিয়ে ভয়ভীতি দেখান। এলাকার বাড়ি নির্মাণে চাঁদা দিতে হয় তাকে। অবৈধভাবে চলা অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। ১০ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করেন হান্নান। ময়লার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহেল রেজার লোকজনের সঙ্গে তার বিরোধ চলে আসছিল।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আবদুল হান্নানের সঙ্গে আবদুর রশিদের বিরোধ। এর জেরেই বুধবার আবদুর রশিদের বাসার সামনে হান্নানের সঙ্গে কথাকাটাকাটি ও হাতাহাতির একপর্যায়ে গুলি ছোড়া হয়। বিষয়টি তদন্ত চলছে। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে পুরো বিষয়টি জানা যাবে।

দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় বালু ব্যবসায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে বুধবার দুপুরে স্থানীয় জাপানি হান্নান ও সোহেল রেজা গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে আবদুর রশিদকে গুলি করে হত্যা করেন জাপানি হান্নান। এতে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে হান্নানের গাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় আবদুর রশিদের ভাই হারুন অর রশিদ দক্ষিণখান থানায় জাপানি হান্নানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার পর জাপানি হান্নানসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নিহত আবদুর রশিদ রাজধানীর আশকোনার পানির পাম্পের পাশে ৪৩৪ নম্বর নিজ বাড়িতে থাকতেন। আগে তিনি গার্মেন্টস এক্সেসরিজের কারখানা পরিচালনা করতেন। সেটি বন্ধ করে বর্তমানে তার বাড়ি ও মার্কেট দেখাশোনা করছিলেন।

 

Comment here