ঢাকার পথে পথে ‘ঘুমায়’ গাড়ি - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ঢাকার পথে পথে ‘ঘুমায়’ গাড়ি

তাওহীদুল ইসলাম : রাতের বেলায় ঢাকা মহানগরজুড়েই রাস্তায় রাস্তায় বাস-মিনিবাস পার্ক করে রাখা হয়। এর বড় অংশই নগর পরিবহনের বাস। এ ছাড়া দূরপাল্লার বাসগুলোও তিনটি আন্তঃজেলা টার্মিনাল ছাপিয়ে আশপাশের বিভিন্ন রাস্তা দখল করে নেয়। অথচ সরকারের সঙ্গে ভাড়া নির্ধারণের সময় গ্যারেজ ভাড়া বাবদ নগর পরিবহনের প্রতিটি বাসের মাসিক খরচ ৬৫ হাজার এবং দূরপাল্লার প্রতিটি বাসের মাসিক খরচ দুই লাখ টাকা দেখানো হয়। এ ছাড়া রাতে ঢাকার রাস্তার বড় অংশ দখল করে রাখে ট্রাক ও পিক-আপ। শুধু রাতে নয়, দিনের বেলায়ও নানা অজুহাতে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বাস-মিনিবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। রাজধানীতে দিন দিন এ সমস্যা বাড়তে থাকলেও সমাধানে কোনো উদ্যোগই এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে মহাখালী বাস টার্মিনালের বাইরে রাস্তার দুধারে পার্ক করে বাস রাখা হয়। ফলে রাতের এ রাস্তায় চলাচলের জন্য একটি মাত্র লেন খোলা থাকে। গাবতলী টার্মিনালকেন্দ্রিক অনেক বাসই পাশের শ্যামলী, কল্যাণপুর ও কলেজগেটসহ আশপাশের এলাকার রাস্তায় সারি সারি রাখা হয়। সায়েদাবাদ টার্মিনালকেন্দ্রিক বাসের সারি ধলপুর, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও শনিরআখড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন মজা করে বলেন, রাতের শনিরআখড়ার রাস্তা হয়ে ওঠে ‘গাড়ির আখড়া’।

নগর পরিবহনের ক্ষেত্রেও একইভাবে চিড়িয়াখানা রোড, মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে পল্লবী, মতিঝিল, নটরডেম কলেজ, রাজারবাগ সর্বত্র বাসের দৌরাত্ম্য চলে। অথচ নিবন্ধনের সময় এসব গাড়ি গ্যারেজে রাখার শর্ত দেওয়া হয়। শর্ত লঙ্ঘন করলে প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব গাড়ি দখল করে ঢাকা শহরের প্রধান সড়ক। ক্ষেত্রবিশেষে ফিডার রোডেও দেখা যায় বাস-মিনিবাস।

সূত্রমতে, ঢাকা ও এর পাশর্^বর্তী এলাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। বাস চলাচলের জন্য টার্মিনাল ব্যবস্থার দায়িত্ব ডিটিসিএ ও সিটি করপোরেশনের। এক সময় গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়াতে টার্মিনাল ছিল। সেটি ভাগ হয়ে ঢাকার তিন স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। স্থানসংকুলান না হওয়ায় এসব টার্মিনালে গাড়ি রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রাস্তায় রাখা হয়। টার্মিনালে গাড়ি থাকার কথা আসা-যাওয়ার জন্য। আর গাড়ি থাকবে গ্যারেজ বা ডিপোতে। নগর পরিবহনের গাড়ি সাধারণত দিনের বেলায় বেশি চলে। আর দূরপাল্লার গাড়ি কিছু কোম্পানির বাস সার্বক্ষণিক চলাচল করে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে গাড়ি রাস্তায় রাখা।

জানা গেছে, ঢাকার যানজট নিরসনের মহাপরিকল্পনা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) ছয়টি নতুন আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। ছয়টি মহাসড়কের মাধ্যমে সড়কপথে ঢাকার সঙ্গে দেশের ৬৩টি জেলার যোগাযোগ হয়। সে হিসেবে কিছু স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে বাস সরাসরি উঠবে মহাসড়কে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালের মাত্র ৮০০টি বাসের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তবে ঢাকার শহরের অভ্যন্তরে রাস রুট পুনর্বিন্যাস কমিটি তথ্যানুযায়ী, এ তিন টার্মিনালে বাস রাখা হয় ৯ হাজার ২৯৮টি। আরও কয়েক হাজার বাস টার্মিনালের আশপাশের রাস্তায় পার্কিং করা হয়। এতে যানজট হয়। এ জন্য বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো ঢাকার উপকণ্ঠে স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে।

কেবল বাস নয়, ট্রাক টার্মিনালের ব্যাপারেও ভাবা হচ্ছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রেলের জমিতে এবং সায়েদাবাদে সিটি করপোরেশনের জমিতে ট্রাকের ডিপো রয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এ দুই ডিপো উচ্ছেদে অনেকবার কথা হলেও বিকল্প না থাকায় করা যায়নি। ডিটিসিএর পক্ষ থেকে ট্রাক টার্মিনাল বাইপাইল ও গাজীপুর স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য বাইপাইলে ৩৭ দশমিক ১ একর এবং গাজীপুরের টঙ্গীতে ১১ দশমিক ৭ একর জমি লাগবে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে কবে, বলতে পারছে না কেউই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস বলেছেন, রাজধানীর প্রবেশপথে হবে চারটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল। রাজধানীতে ঢুকতে পারবে না দূরপাল্লার বাস।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রুটে বাসগুলো রাখার জায়গা নেই। রাস্তায় পার্ক করায় সমস্যা হয়।

তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক গাড়ির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনাল থাকা বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে শহরের ভেতরে সহজে প্রবেশ করতে পারা নিশ্চিত করতে হবে। সিএনজি অটোরিকশা কিংবা অন্য বাহন দিয়ে ভোগান্তিসহ চড়া মূল্যে ঢাকায় আসা-যাওয়া যেন বিড়ম্বনা না হয়। কারণ নগরীতে গণপরিবহন সংকট আছে। এখন পর্যন্ত নেই মেট্রো বা বিআরটির মতো ব্যবস্থা। তাই টার্মিনাল স্থানান্তরে ভোগান্তি কমার বদলে যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার এটাও ঠিক, বর্তমানে যেভাবে শহরে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি রাখা হচ্ছে, এটি কোনো আধুনিক শহরের পরিচয় হতে পারে না।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আমাদের সময়কে বলেন, শহরের বাইরে টার্মিনাল স্থানান্তর ছাড়াও সমাধানের পথ আছে। মূলত পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে। দূরপাল্লার বা নগর পরিবহন সবক্ষেত্রেই বহুমালিক প্রথার পরিবর্তন দরকার। নির্ধারিত সময়ে একটি গাড়ি আসবে এবং সময়মতো টার্মিনাল ছেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। বিপুল পরিমাণ বাস টার্মিনালে অলস বসে থাকার কথা নয়। এখানে ব্যবস্থাপনারও ঘাটতি আছে।

ড. শামসুল হক বলেন, নগর পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অনুমোদনের আগেই ওই গাড়ির গ্যারেজ বা ডিপোর বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা সংশ্লিষ্ট বাস কোম্পানির। এটি সম্ভব হলে শহরের রাস্তা দখল করে গাড়ি থাকার কথা নয়। দেশে বিনা খরচে রাস্তায় গাড়ি রাখার মানসিকতা চলছে। এমনকি মেরামতও করা হয় রাস্তায় রেখে। রুট পারমিট, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সব কিছু এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো শহরে এভাবে বাস রাস্তায় থাকতে পারে না।

সড়ক পরিবহন আইনের ৪৭ ধারা অনুযায়ী, গাড়ির যাত্রী ওঠানামা, পার্কিং নির্ধারণ করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া মোটরযান পার্কিং করা যাবে না এবং যাত্রী বা পণ্য উঠানামার নির্ধারিত স্থান ও সময় ব্যতীত মোটরযান থামানো যাবে না। কোনো যাত্রী বা সড়ক ব্যবহারকারী মোটরযান চালক বা শ্রমিককে নির্ধারিত পার্কিং এলাকা ব্যতীত অন্য কোনো এলাকায় মোটরযান পার্কিং করিতে এবং যাত্রী ও পণ্য উঠানামার নির্ধারিত স্থান ও সময় ব্যতীত মোটরযান থামাতে অনুরোধ বা বাধ্য করিতে পারিবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪৭-এর বিধান লঙ্ঘন করেন, তা হলে অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা অর্থদ-ে দ-িত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কর্তন হবে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ভাড়া নির্ধারণের সময় আজগুবি খরচ দেখানো হয়। সেখানে গ্যারেজ ভাড়ার মতো নানা খরচ দেখানো হয়, যা অদৃশ্যমান। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ মেরামতে বছরে খরচ সোয়া ১০ লাখ টাকা! প্রতি তিন মাস অন্তর ২৬ হাজার টাকার টায়ার লাগানো হয়। বছরে টায়ার টিউবের খরচ ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা দেখানো হয়। এ ছাড়া ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার, রেনোভেশনে লাগে ১ লাখ ৩০ হাজার এবং চালক শ্রমিকদের মজুরি বছরে পৌনে ৭ লাখ টাকা দেখানো হয়। একাধিক পরিবহন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, চাঁদা, পুলিশের ঘুষ বাবদ বছরে প্রতিটি বাসের পেছনে ৫-৬ লাখ টাকা যায়। তা ব্যয় বিশ্লেষণে দেখানো যায় না। ফলে বাকি খরচ বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখাতে হয়।

জানা গেছে, ঢাকার রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখার সমস্যা দূর করতে এবং যানজট কমাতে ঢাকা শহরের বাইরে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের যে পরিকল্পনা সরকার করছে, তা বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। শুধু ছয়টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণে এ ব্যয় হবে। লোকাল বাস ও ট্রাক টার্মিনাল রাজধানীর বাইরে নিতে পাঁচটি ডিপো নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খরচ আরও বাড়বে।

গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালীর থেকে টার্মিনাল সরিয়ে রাজধানীর প্রবেশপথে কেরানীগঞ্জের বাঘাইর, সাভারের হেমায়েতপুর ও বিরুলিয়া, নারায়াণগঞ্জের ভুলতা, কাঁচপুর সেতু ও কাঁচপুরের মদনপুরে ছয়টি আন্তঃজেলা বাস টানির্মাল নির্মাণে ১২ হাজার ৫১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাস টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ধারণাগত নকশা প্রণয়ন প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে খরচের এ হিসাব এসেছে।

তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর উপকণ্ঠের ৯টি এলাকার ১৬টি স্থানে জরিপ শেষে ১০টিকে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এবং লোকাল বাস ও ট্রাকের ডিপো নির্মাণের চিহ্নিত করা হয়েছে। কাঁচপুর উত্তরে আন্তঃজেলা টার্মিনালের সঙ্গে লোকাল বাসের ডিপোও হবে। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলের কাঞ্চন এবং কেরানীগঞ্জের আটিবাজারের ভাওয়াল এলাকা বাস ডিপো হবে। আশুলিয়ার বাইপাইল ও গাজীপুরে বাস ও ট্রাকের ডিপো হবে বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রস্তাব করা হয়েছে।

গাবতলী টানির্মালে ২২ একর, মহাখালীতে ৯ একর এবং সায়েদাবাদে ১০ একর জমি রয়েছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন বাঘাইরে ৩৩ দশমিক ৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। হেমায়েতপুরে ৪৫ একর, বিরুলিয়ার ভাটুলিয়ায় ২৬ দশমিক ৭ একর, কাঁচপুর দক্ষিণে ২৬ দশমিক ৭ একর, কাঁচপুর উত্তরে ১৫ দশমিক ৫ একর এবং ভুলতায় ২৪ দশমিক ২ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে টার্মিনাল নির্মাণে।

ছয়টি আন্তঃনগর টার্মিনাল নির্মাণে যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, তার বড় অংশই যাবে জমির জন্য। আট হাজার ২০২ কোটি টাকা লাগবে জমি অধিগ্রহণে। হেমায়েতপুরে টার্মিনাল নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ১২৩ কোটি টাকা। জমির জন্য লাগবে দুই হাজার ১০২ কোটি টাকা। টার্মিনাল নির্মাণে ৫৬৪ কোটি এবং জমি ভরাটে ২৫৯ কোটি লাগবে। কাঁচপুর উত্তরে টার্মিনাল ও ডিপো নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ২৭ কোটি টাকা। জমির জন্যই লাগবে ৭৮৯ কোটি টাকা।

 

Comment here