তলানিতে পাসপোর্ট সেবা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

তলানিতে পাসপোর্ট সেবা

আরিফুজ্জামান মামুন : এক. আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন রফিক। ইতালি প্রবাসী এ যুবকের চেহারায় রাজ্যের উদ্বেগ। তার নতুন পাসপোর্টে কিছু তথ্য সংশোধন করা জরুরি। এ জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রও দাখিল করেছেন কর্তৃপক্ষ বরাবর। কিন্তু দিনের পর দিন যাচ্ছে, পাসপোর্ট পাচ্ছেন না তিনি। ফলে নিজ কর্মস্থল ইতালিতেও যেতে পারছেন না অনেক দিন হলো। মনের ভেতর ভীষণ উদ্বেগ। সেই উদ্বেগের ছাপ পড়েছে মুখেও।

দুই. ধানমন্ডির বাসিন্দা সুফিয়া বানু। চিকিৎসার জন্য যত দ্রুত সম্ভব দেশের বাইরে যাওয়া প্রয়োজন তার। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট পেতে অনলাইনে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তার বায়োমেট্রিকের জন্য সময় দেওয়া হয়েছে ডিসেম্বর মাসে। চিন্তায় তার শরীর যেন চলতে চাইছে না; দুই পা অসাড় হয়ে পড়তে চাইছে। মনে মনে ভাবছেন, তত দিন তিনি বাঁচবেন তো?

অর্থনীতির চাকা সচল রেখে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে কটি খাত, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেমিট্যান্স। ইতালি প্রবাসী রফিকের মতো অসংখ্য বাংলাদেশিই এ খাতের চালিকাশক্তি। অথচ পাসপোর্ট বিড়ম্বনায় এমন অনেক রফিকের মুখেই আজ উদ্বেগ; তাদের স্বজনদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে উৎকণ্ঠা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, দেশেই শুধু নয়; দেশের বাইরে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও একই সমস্যা। নানা কারণে পাসপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় এমনকি ভিসা বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। জানা গেছে, প্রবাসে বৈধতার সুযোগ পেয়েও শুধু যথাসময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ায় অবৈধই রয়ে যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি কর্মী। ভুক্তভোগীদের স্বজনরা পাসপোর্ট বিড়ম্বনা নিরসনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গত রবিবার মানববন্ধন পর্যন্ত করেছেন। প্রবাসীকর্মীদের একাধিক স্বজন জানিয়েছেন, পাসপোর্ট জটিলতার কারণে প্রবাসে কর্মরতদের অনেকে সে দেশে কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না; বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবাপ্রাপ্তি থেকে। আরও উদ্বেগজনক হচ্ছেÑ তাদের কেউ কেউ পাসপোর্ট না থাকায় ফিরে আসার পথও বন্ধ হয়ে আছে। বেতন আটকে থাকা বা চাকরিচ্যুতির কারণে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। এ প্রতিবেদককে এমন তথ্যও জানিয়েছেন স্বজনরা।

গত রবিবার রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট প্রত্যাশী অনেকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অনলাইনে পাসপোর্ট আবেদন করার পর দুই মাসের বেশি সময় লাগে কাগজপত্র জমা দেওয়ার সিরিয়াল পেতে। জমা দিতে গিয়ে ভিড় ঠেলে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে আবেদন জমা দিতে হয়। লাইনে দাঁড়াতে হয় পাসপোর্ট আনতে গিয়েও। এ ছাড়া ছোটখাটো ভুলের কারণে ব্যাপক ভোগান্তি তো আছেই। লালমাটিয়ার বাসিন্দা নূরুন নাহার বেবির দরকার জরুরি পাসপোর্ট। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে আসার পর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বললেন, আমি এখানে পাসপোর্টের জন্য এসেছি, কোনো দুর্যোগের পর ত্রাণ নিতে আসিনি। টাকা দিয়ে আবেদন করেছি। অন্তত একটু বসার জায়গা থাকা উচিত।

এ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে দালালদের বহুদিনের দৌরাত্ম্য শেষ হয়নি এখনো। বেশ ক’জন জানান, অনলাইন আবেদনের কাজে সহায়তা করতে আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের ঠিক সামনে বসা অস্থায়ী টঙগুলোতে নাকি সব সমস্যার সমাধান মেলে। ছবি তোলার তারিখ, ব্যাংকে টাকা জমা, যে কোনো সংশোধন, টাকা দিলে নাকি এখানে পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়ে যায়।

সেবাগ্রহীতারা বলছেন, নিয়মানুযায়ী পাসপোর্ট করতে গেলে পদে পদে পোহাতে হয় নানা ঝক্কিঝামেলা। অথচ পাসপোর্ট অফিসের সামনে কিছু পয়সা খরচ করলেই সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা। দালালরা ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় করছেন সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে। পরিচয় গোপন করে এ প্রতিবেদক শরণাপন্ন হন দালালের। ১৬ অক্টোবর (রবিবার) পূরণ করা একটি আবেদন জমা দিয়ে দেওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে ৩৫০০ টাকা দাবি করা হয়।

অ্যাপয়েনমেন্ট ডেট ডিসেম্বরে হলেও আগে কীভাবে জমা করে দেবেন এমন প্রশ্ন করা হলে দালালের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমাদের সেটিং আছে।’ অবশ্য পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয় বলে জানান। তাদের দাবি, খুব সামান্য কয়েকটি ঘটনা চোখ এড়িয়ে ঘটে থাকে। এ ছাড়া ঘুষ দিয়ে আবেদন জমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কথা থাকলেও সময়মতো পুলিশ ভেরিফিকেশন না আসা বা তথ্যের পরিবর্তন বা সংশোধন জটিলতায় সময়মতো পাসপোর্ট না পাওয়ার চিত্র বেড়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে অর্থ আদায় ওপেন সিক্রেট বিষয়। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে অর্থ আদায় বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট শাখা। তথ্য সংশোধনের আবেদনের কারণে পাসপোর্ট পেতে বিলম্বেও অভিযোগ সব থেকে বেশি। পাসপোর্ট সংশোধন করতে এসে ভোগান্তিতে পড়ছেন প্রবাসীরা।

এ বিষয়ে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু জানান, কয়েক মাস আগেই বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারির অপেক্ষায় আছেন তারা। সব মিলিয়ে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সেবা তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি এবং গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি প্রতিষ্ঠানে সেবার মান নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ। কর্মকর্তারা অবশ্য দুষছেন জনবল সংকটকে। বলছেন, অবকাঠামো ও লোকবল সংকটের কারণে নিয়ম মেনে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট জমা ও বিতরণ করতে পারছেন না তারা।

সূত্র জানায়, ঢাকা আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে বর্তমানে ২৫৬০টি আবেদন প্রক্রিয়া করার সক্ষমতা আছে। জমা পড়ে ৩ হাজারের বেশি আবেদন। এতে মানুষ দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। এ ছাড়া এই ৩ হাজার জনের সঙ্গে থাকে তাদের প্রায় দুই হাজার আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতেও একই পরিমাণ লোক আসেন। আবার ভুল তথ্য সংশোধন চেয়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আসেন। প্রতিনিয়ত এ বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করছেন। পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। বাইরেও থাকে লোকের দীর্ঘ লাইন। কর্মকর্তারা জানান, যে তিন হাজার আবেদন পড়ে, এর মধ্যে ৮শর অধিক আবেদনে কোনো না কোনো ত্রুটি থাকে। কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে যে জনবল ও জায়গা রয়েছে, তাতে দিনে ৪০০ থেকে ৪৫০টি আবেদন জমা পড়লে সুন্দরভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের অবকাঠামো এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেবা দেওয়া উপযোগী নয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, এত আবেদন সঠিক সময়ের মধ্যে সমাধান করে সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই জরুরি ভিত্তিতে আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার। এ ছাড়া আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের জনবলও বাড়ানো দরকার। মাসে অন্তত ৫ লাখ পাসপোর্ট মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অফিস (ডিআইপি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা ও সুরক্ষা বিভাগে ৯শ জনবল চেয়ে আবেদন করেছে ২০১৭ সালে। এ জনবল নিয়োগ হলে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলবে বলে মনে করছেন ডিআইপির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ঢাকায় পাসপোর্টের আবেদন প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে ব্যাংক, বিআরসি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের কাজ রয়েছে। কোনো কারণে কোনো একটি সংস্থার সার্ভারে ঝামেলা হলে পাসপোর্ট অফিসের চলমান কাজে বিঘœ ঘটে। সেবা পেতে দেরি হলে শুধু পাসপোর্ট অফিসের দোষ হচ্ছে। অনেক সময় পুলিশের প্রতিবেদন পেতে দেরি হয়। প্রতিটি আবেদনের জন্য বায়োমেট্রিক করতে হয়। একেকটি বায়োমেট্রিকের জন্য ন্যূনতম ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। এতে আবেদনকারীকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

সূত্র জানায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিদিন সক্ষমতার বেশি কাজ করায় তাদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ইতোমধ্যে চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিকিৎসা করানো হয়েছে বলে জানা গেছে। পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী জাকির হোসেন ডাটা অ্যান্ট্রির কাজ করেন। দীর্ঘদিন কম্পিউটারের সামনে বসে ডাটা অ্যান্ট্রি ও অতিরিক্ত কাজের চাপে ডান হাতে সমস্যা দেখা দেয়। পরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। নিয়েছেন থেরাপিও।

এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ইউসুফ বলেন, আমরা সক্ষমতার থেকে বেশি সেবা দিচ্ছি। ফলে দীর্ঘক্ষণ মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এতে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। জনবল সংকট কেটে গেলে আমরা ভালোভাবে সেবা দিতে পারব। সক্ষমতারও বেশি সেবা দিতে গিয়ে কি ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের কাজ করার একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। প্রতিদিন আমার কাছে ৫০০-৬০০ জন লোক আসেন। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে মেজাজ স্বাভাবিক কারণেই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। যেটার প্রভাব আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও পড়ছে। আমি নিজেও মাজার ব্যথার সমস্যায় ভুগছি। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব এ বিষয়ে বলেন, ওয়ার্ক লোড বেশি হলে কাজের কোয়ালিটি নষ্ট হবে। কাজে মনোযোগ নষ্ট হবে। ওয়ার্ক লোড বেশি হলে ব্যবহার অনেক সময় রূঢ় হয়ে যায়। পরিবারেও মনোযোগ দেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।

ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতিদিন ২ হাজার ৫৬০ পাসপোর্ট জমা নেওয়া হচ্ছে। প্রায় একই পরিমাণ পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। একেকটি পাসপোর্ট জমা ও ডেলিভারি দিতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। যার কারণে পাসপোর্ট জমা ও ডেলিভারিতে ভিড় বাড়ছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ছে, সে অনুযায়ী সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার। আর জনবল না বাড়ালে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া সম্ভব না। অন্তত আরও ২৩০ জনের মতো জনবল দিলে সেবার মান ভালো করা সম্ভব।

 

Comment here