তিন কারণে জামিন মেলেনি পরীমনির - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

তিন কারণে জামিন মেলেনি পরীমনির

রহমান জাহিদ : তিন দফা সাত দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে আছেন ঢাকাই সিনেমার আলোচিত ও সমালোচিত নায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি। শক্তিশালী আইনজীবী প্যানেলের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েও মিলছে না জামিন। আইন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য দেখছেন এর তিন কারণ- জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা, বারবার রিমান্ড আবেদন ও মিডিয়ায় আসামিকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো।

বনানীর নিজ বাসা থেকে মাদকসহ গত ৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হওয়া এ চিত্রনায়িকাকে সিএমএম আদালত জামিন না দেওয়ায় এবার মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেছেন তার আইনজীবীরা। গতকাল রবিবার অ্যাডভোকেট মো. মজিবুর রহমান জামিন আবেদনটি দাখিল করলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশ তা গ্রহণ করে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ঠিক করেন।

মামলায় দেখা যায়, পরীমনির বাসা থেকে সাড়ে ১৮ লিটার বিদেশি মদ, চার গ্রাম আইস, এক ব্লট এলএসডি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১), ২৪(খ), ২৯(ক), ১০(ক) এবং ৪২ ধারায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। অপরাধ প্রমাণিত হলে এর মধ্যে ৪২ ধারায় এক বছর, ২৪(খ) ধারায় তিন থেকে পাঁচ বছর, ১০(ক) ও ২৯(ক) ধারায় এক থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সাজা হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাটির ৪২ ধারা ছাড়া অপরগুলো জামিন অযোগ্য। তাই তিনটি জামিন অযোগ্য ধারা থাকায় এতদিনেও জামিন পাননি পরীমনি। এ ছাড়া জামিন অযোগ্য ধারার কোনো মামলায় আসামির বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন থাকলে সাধারণত আদালত জামিন দেন না। পরীমনির মামলায় পুলিশ গত ৫ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত তিন দফা রিমান্ড আবেদন করেছে। তাই এ সময়ের মধ্যে জামিন মেলেনি। অন্যদিকে যেসব মামলার বিষয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার হয়, সেগুলোতে আসামিকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত জনসাধারণের মনোভাব বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। পরীমনির ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিপক্ষে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘মামলাটিতে চারটি ধারা রয়েছে, যার তিনটিই জামিন অযোগ্য। আসামির কাছে ভয়ানক মাদক পাওয়া গেছে। সিএমএম আদালত সাধারণত এ ধরনের মামলায় জামিন দেন না।’ আসামি একজন নারী হওয়ার পরও বারবার রিমান্ড আবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ‘আসামির কাছে যে ভয়ানক মাদক পাওয়া গেছে তা কোথা থেকে এলো, সেটি জানা দরকার। কিন্তু সেটি আসামি প্রকাশ না করায় বারবার রিমান্ড আবেদন করতে হয়েছে। আবার দেখবেন, মামলার তদন্ত প্রথমে ডিবির কাছে ছিল। এর পর সিআইডিতে গেল। তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলে সাধারণভাবেই নতুন যারা দায়িত্ব পায় তারা রিমান্ড আবেদন করে থাকে।’

পরীমনির আইনজীবী মজিবুর রহমান অবশ্য বলেন, ‘মামলার তিনটি ধারা জামিন অযোগ্য হলেও সাজা এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। চার্জশিট দাখিল হলে সিএমএম আদালতই মামলাটির বিচার করবেন। তাই আদালত চাইলে তার আসামিকে জামিন দিতে পারতেন। কিন্তু বারবারই আমাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। অবশ্য জামিন নামঞ্জুর করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। তাই আমাদের কিছু বলার নেই। আশা করছি দায়রা জজ আদালত থেকে আমরা জামিন বঞ্চিত হব না।’

ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজিব বলেন, ‘সাধরণত মাদক মামলায় একবারের বেশি রিমান্ড আবেদন দেখা যায় না। অধিকাংশ সময় তা নামঞ্জুর হয়ে থাকে। কারণ মাদক উদ্ধার হয়ে থাকলে রিমান্ডের আর প্রয়োজন হয় না। নারীদের বেলায় রিমান্ডের ক্ষেত্র তো আরও কম। তাই পরীমনির ক্ষেত্রে মাদক আইনের মামলায় বারবার রিমান্ড আবেদন অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাদক আইনের ৪৭ ধারায় নারী বিবেচনায় জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে পরীমনি সুবিধা পাবেন।’

এদিকে গ্রেপ্তারের পরদিন অর্থাৎ গত ৫ আগস্ট নায়িকা পরীমনি ও প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ এবং তাদের ম্যানেজারদের মাদক মামলায় চার দিন করে রিমান্ডে পায় পুলিশ। গত ১০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় আরও দু’দিন করে আসামিদের রিমান্ডে পাঠান সিএমএম আদালত। সর্বশেষ গত ১৯ আগস্ট পরীমনির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তৃতীয় দফা একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। এর পর গত ২১ আগস্ট ওই একদিনের রিমান্ড শেষে পরীমনিকে আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। ওইদিন অবশ্য তার জামিন চাওয়া হয়নি।

পরীমনির বিরুদ্ধে দায়ের মামলায় বলা হয়, জব্দ মাদকদ্রব্য কবির নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করে বাসায় রাখতেন এ নায়িকা। মামলায় অবশ্য কবিরের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা উল্লেখ নেই। একই মামলায় আবার র‌্যাব দাবি করেছে, চিত্রনায়িকা পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তিনি প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করতেন। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যেসব ধারায় পরীমনির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- হতে পারে পরীমনির।

চিত্রনায়িকার ন্যায়বিচার চায় নাগরিক সমাজ

‘পরীমনির জন্য ন্যায়বিচার চাই’ ব্যানারে মাঠে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, সাংস্কৃতিকর্মী ও তার ভক্তরা। গতকাল রবিবার বিকালেও রাজধানীর শাহবাগে তারা নাগরিক সমাবেশে শামিল হন। ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিকজন’র আয়োজনে ওই সমাবেশে এক ভিডিওবার্তায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী; তার পরও নারীকে কেন অপমানিত হতে হবে? পরীমনিকে কেন বারবার রিমান্ডে নিতে হবে? কেন আদালত পুলিশের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো জারি করবেন না?’ আদালতের রায়ের আগেই সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে পরীমনিকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শাহরিয়ার কবির। নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূল সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকেও সংযত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সমাবেশে ফোনকলে যুক্ত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, পরীমনির জামিনের আবেদনটা অত্যন্ত অন্যায়ভাবে শোনা হচ্ছে না। তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করতে গেছেন, করতে দেওয়া হয়নি। তার আইনজীবী পরীমনির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এটা কোনো আদালত করতে পারেন না। এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদি বিচারক উপস্থিত থাকেন ও আসামি কাঠগড়ায় থাকেন, তখন আইনজীবী কথা বলতে পারেন না। এর বাইরে অন্য কোনো সময় আইনজীবী কথা বলতে পারবেন না- এমন কোনো আইন নেই।’ সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘একটি মানুষ কোনো একটি অপরাধের শিকার হয়ে মামলা করেছিলেন। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তখন থেকেই তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাকে হেনস্তা করার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজের হাতে তুলে নিল। একজন নারীকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হচ্ছে, তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।’

সমাবেশে মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির ফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘একজন ব্যক্তির বাসায় অভিযান পরিচালনার জন্য এতগুলো গাড়ি, পুলিশ, র‌্যাব নিয়ে গেছে। মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি, দেশের কোনো নাগরিকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করা যায় না। তাকে তিনবারে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। নারী ও সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে তাকে সম্মান দেখাতে তো ব্যর্থ হয়েছেই, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করা হয়েছে।’ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পরিচালক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক আকরামুল হক প্রমুখ।

Comment here