ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে রূপনগর বস্তিবাসী - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে রূপনগর বস্তিবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক : চল্লিষোর্ধ্ব মর্জিনা বেগম যে ছাইয়ের গাদায় বসে আছেন, সেখানেই ছিল তার ঘর। এখন এর লেশমাত্রও নেই। সব কেড়ে নিয়েছে আগুনের লেলিহান শিখা। শুধু কিছু ঢেউটিন পড়ে আছে। মাথা গোঁজা যাবে না এসব টিনের নিচে। অনন্যোপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত টিনগুলো ৮ টাকা কেজি দরে ভাঙারির দোকানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তার রিকশাচালক স্বামীর সেই সক্ষমতা নেই যে, ফের একটি ঘর তুলবেন। স্ত্রী ও দুই সন্তানের সংসার টানতেই তার নাভিশ্বাস দশা। কী করবেন মর্জিনা, ভাবতেও পারছেন না। কারণ ভাবতে গেলেই দিশা হারিয়ে ফেলছেন। খোলা আকাশের নিচের এই জায়গাটুকু ছেড়ে একবার গেলে তা-ও হারাবেন। তাই এখানেই বসে আছেন তিনি। বুঝতে পারছেন, এই ধ্বংসস্তূপেই ফের গড়তে হবে জীবনের গাঁথুনি; এসব জঞ্জাল সরিয়ে এখানেই দুই সন্তানের জন্য বুনতে হবে স্বপ্নের বীজ। এটি রূপনগর বস্তির একজন মর্জিনার জীবন-সংগ্রামের গল্প। এমন অসংখ্য মর্জিনা রয়েছেন রাজধানীর মিরপুরের এই বস্তিতে। গত বুধবার সকালে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে বস্তিটির ছয়-সাতশ ঘর। মর্জিনাদের তাই পথে বসতে হয়েছে। তবু হাল ছাড়েননি মর্জিনারা। অথৈ সাগরে ডুবে যাওয়ার আগে খড়কুটো দেখেও যেমন আশা জাগে, সেটা ধরে অন্তত ভেসে থাকতে ইচ্ছে হয়, মর্জিনাদেরও তা-ই। আগুনে আশ্রয়হারা রূপনগর ট-ব্লকের বস্তির দরিদ্র মানুষগুলো এই ধ্বংসস্তূপেই নতুন করে জীবনের ছক আঁকছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বস্তিতে গিয়ে এমনটাই দেখা গেছে। ঘরপোড়া বস্তিবাসী আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের স্কুলমাঠ ও ফাঁকা জায়গায়। বস্তিতে নতুন করে ঘর তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

অনেক বস্তিবাসীর অভিযোগ, তাদের উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বস্তি ঘিরে যারা ঘরভাড়া, অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস থেকে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন এতদিন, তাদের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলছেন অনেক বস্তিবাসী। এই অবৈধ আয় নিয়ে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এই দ্বন্দ্বের জেরে কোনো পক্ষ আগুন লাগাতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তা ছাড়া এই বস্তিতে আবাসন প্রকল্প করার পরিকল্পনা চলছে। তাই বস্তি উচ্ছেদ করতে আগুন লাগানো হতে পারে।

মর্জিনা বেগম জানালেন, তারা ১০ ভাই-বোন। সবারই এখন আলাদা পরিবার রয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজন মিলে বস্তিতে ২৩টি ঘর ছিল। ৩০ বছর ধরে তাদের এ বস্তিতে বসবাস। তার বাবা সুলতান শেখ এ বস্তিতে আবাস গড়ে তোলেন। ২০ বছর আগে এখানে, এই বস্তিতেই মর্জিনার বিয়ে হয়। তার স্বামী সবুজ মিয়া পেশায় একজন রিকশাচালক। আগুনে ঘরের সব পুড়ে গেছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের সব সরঞ্জাম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি এ বস্তি ছেড়ে যেতে চান না। এখানেই নতুন করে ঘর তুলে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চান।

মর্জিনা বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, পাশেই বসা ছিলেন তার ভাই চান মিয়ার স্ত্রী পাখি বেগম। আগুনে সর্বস্ব হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন পাখি। তিনি বলেন, এখন তো আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাবপত্রসহ অনেক মালামাল ছিল। কিন্তু আগুনে সব ছাই হয়ে গেছে। এমনকি একটি থালাও ঘর থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। অনন্যোপায় পাখি বলেন, সরকার যদি একটু দৃষ্টি দিত, আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করত… বলে থামেন তিনি। এর পর ঠোঁট খানিকটা নড়লেও কোনো শব্দ বেরোয় না তার কণ্ঠ হয়ে।

সত্তরোর্ধ্ব আলাউদ্দিন। বুড়ো কাঁদছেন। পাশেই স্ত্রী রাবেয়া বেগমও আছেন। দুজন বসে আছেন তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরের কাছে। আলাউদ্দিন জানান, বয়স হওয়ার কারণে চোখে তেমন একটা দেখেন না। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। ষাটোর্ধ্ব স্ত্রীর ভিক্ষাবৃত্তিতে চলে দুজনের সংসার। এখন এই বয়সে কী দুর্ভোগ যে আছে ভাগ্যে, এ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন আলাউদ্দিন; অবুঝ শিশুর মতো কাঁদছেন।

রাবেয়া বেগম বলেন, ভোলার বোরহানউদ্দিনে ছিল তাদের বাড়ি। নদীভাঙনে সব হারিয়ে ৪৫ বছর আগে ঢাকার মিরপুরে চলে আসেন। এই বস্তিতে প্রায় ২০ বছর ধরে বসবাস করছিলেন। এখন তারা কী করবেন, কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না।

বস্তি ঘিরে কোটি টাকার বাণিজ্য : সরেজমিন বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিলপাড় বস্তির আরামবাগ অংশ থেকে ‘ট’ ব্লক হয়ে শিয়ালবাড়ী পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ঘর রয়েছে। আগুনে এ অংশটি পুড়েছে। এ অংশের ঘরভাড়া, অবৈধ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাঁচজনের হাতে। এসব খাত থেকে তারা প্রতিমাসে প্রায় দেড় কোটি হাতিয়ে নিত। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে তারা এই বিশাল বস্তি নিয়ন্ত্রণ করত।

বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তির প্রতিঘরের ভাড়া গড়ে প্রায় দুই হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতিমাসে প্রায় এক কোটি টাকা আদায় হতো বস্তি থেকে। প্রতিটি গ্যাসের চুলা থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিত ৬০০ টাকা করে। প্রায় দুই হাজার চুলায় মাসে পেত ১২ লাখ টাকা; পানির বিল হিসেবে মাসে আদায় হতো প্রায় ১০ লাখ টাকা; বিদ্যুৎ থেকে প্রায় ১৫ লাখ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব আলী বলেন, এ বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সব লাইনই ছিল অবৈধ। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।

Comment here