নিষ্ফল প্রকল্পে রেলের মায়া - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

নিষ্ফল প্রকল্পে রেলের মায়া

তাওহীদুল ইসলাম : বাংলাদেশ রেলওয়েতে একদিকে যখন জনবল ও ইঞ্জিন-বগির তীব্র সংকট, অন্যদিকে তখন নিষ্ফল অনেক প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। একের পর এক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি বরং কমেছে। প্রকল্পের আওতায় কোনো কাজ ছাড়াই বেতন নিচ্ছেন অনেক কর্মকর্তা; হাঁকাচ্ছেন দামি গাড়ি। এমনকি প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য নয় জেনেও সেটি আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে; প্রকল্প বাতিল না-করার পক্ষে দেখানো হচ্ছে নানা খোঁড়া যুক্তি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেলওয়েতে এমন অন্তত তিনটি প্রকল্প রয়েছে, যেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বছরের পর বছর কর্মহীন অলস সময় পার করছেন। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা অবসরেও চলে গেছেন। কিন্তু প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২১টি ইঞ্জিন মেরামতের লক্ষ্যে; ৭০টি ইঞ্জিন সংগ্রহের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। আরেকটি ২০০ কোচ কেনার প্রকল্প।

ইঞ্জিন মেরামতের প্রকল্পে তিন বছরে তিনবার দরপত্র আহ্বান করেও সাড়া পায়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এমনকি দরপত্রের শর্ত শিথিল করার পরও কোনো দরদাতা আগ্রহ দেখাননি। সঙ্গত কারণেই প্রকল্পটি বাতিলের পরামর্শ দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু রেলের কর্তারা এটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। এ জন্য নানা খোঁড়া যুক্তি দেখাচ্ছে রেলের রোলিংস্টক বিভাগ।

advertisement 4

বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে একপর্যায়ে কারিগরি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিপক্ষে। তাই গত সপ্তাহে রেল মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পটি বাতিল করতে পুনরায় নির্দেশ দেওয়া হয়। এখন বছরে তিন থেকে চারটি ইঞ্জিন মেরামত করা হবে। আর প্রকল্প বাতিলের অংশ হিসেবে আইএমইডিতে চিঠি দেবে বাংলাদেশ

রেলওয়ে। এরপর তা যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দেওয়া হতে পারে। জানা গেছে, ইঞ্জিন মেরামতের ২৪২ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। প্রকল্পের মেয়াদ ওই বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রতিটি ইঞ্জিন মেরামতে ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি টাকা। একটি নতুন ইঞ্জিন কিনতে সিডি-ভ্যাটসহ খরচ পড়ে ৩৫ কোটি টাকা। অথচ মেরামতের জন্য এত টাকা বরাদ্দের পরেও দরদাতা মিলছে না। কারণ হিসেবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২১টির মধ্যে অন্তত তিনটি ইঞ্জিন কোনোভাবেই মেরামত করা সম্ভব নয়। বিষয়টি ঠিকাদাররা লিখিতভাবে রেলকে জানিয়ে দিয়েছে।

রেল সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৯১টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৪০টিই মেয়াদোত্তীর্ণ; ব্রডগেজের ৯৩টির মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৪৩টি। ঠিকাদারের মাধ্যমে ঋণ জোগাড় করে বাকি দুটি প্রকল্প হাতে নেয় রেল ২০০ কোচ ক্রয়ের একটি, অন্যটি ৭০টি ইঞ্জিন ক্রয়ের। দুটি প্রকল্পই ২০১১ সালে অনুমোদনপ্রাপ্ত।

২০০ কোচ কেনায় ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৯২৭ কোটি টাকা। এ জন্য ঋণ দেওয়ার কথা চীনের ক্রেডিট এগ্রিকোল করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের। ঋণের পরিমাণ ধরা হয় ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ ইউরো।

রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং’ বা সরবরাহকারীর ঋণে ২০০টি মিটারগেজ কোচ কেনা হবে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘সিআরআরসি সিফাং কোম্পানি লিমিটেডের’ দেওয়া তথ্য নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দরপত্রে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রীবাহী ক্যারেজ উৎপাদনের সক্ষমতা এবং মানসম্পন্ন যাত্রীবাহী ক্যারেজ রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্য পর্যাপ্ত নয়। ২০০ কোচ কেনার প্রকল্পটি গ্রহণের আগে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণকালে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যেন ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) করা হয়, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

অন্যদিকে ঠিকাদারের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্পে আছে চড়া সুদের শর্ত। এই কঠিন শর্তের কারণেই চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলের নির্দেশনা আসে অর্থ বিভাগ থেকে। অথচ এক যুগ ধরে কিছু ব্যক্তি প্রকল্পের নামে বেতনভাতা ও গাড়িসহ রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করছেন। সূত্রমতে, এত বছর পর ধরে চলে আসা ‘অপচয়ের’ পরও এখন চিন্তাভাবনা চলছে বিকল্প ব্যবস্থায় প্রকল্পটি জিইয়ে রাখার।

এ প্রকল্পে ২ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা কোরীয় কোম্পানির। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘হুন্দাই রোটেম’র এ ঋণ জোগাড় করার কথা। কিন্তু চড়া সুদের শর্ত দিয়ে বসে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) ও জাপানের সুমিতোমো মিটসুই ব্যাংকিং করপোরেশন (এসএমবিসি)। তাদের শর্তের কারণে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলের নির্দেশনা দেয় অর্থ বিভাগ।

‘প্রকল্পের যৌক্তিকতা সাংবাদিকদের বোঝার কথা না’

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর তা বাতিল করা কঠিন। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে কোনোভাবে সম্পন্ন করতে। আর এগুলো কারিগরি বিষয়। প্রকল্পের যৌক্তিকতা সাংবাদিকদের এত ভালো বোঝার কথা না। এটি প্রকৌশলীরা ভালো বুঝবেন।’

 

Comment here