নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্নীতি মামলায় দ-িত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দ- ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে তাকে দুই শর্তে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১ ধারা অনুযায়ী বয়সের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মানবিক কারণে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। মুক্তিকালীন খালেদা জিয়াকে ঢাকায় তার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। তিনি বিদেশ যেতে পারবেন নাÑ এ দ্ইু শর্তে মুক্তি মিলছে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর।
গতকাল মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এ সিদ্ধান্তের তথ্য তুলে ধরেন। দ- স্থগিতের প্রস্তাব বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আদেশে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করলে তা কারাগারে পাঠানো হবে। তারপরই বেগম জিয়া মুক্তি পাবেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সন্ধ্যায় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতারা
বৈঠক করে। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মুক্তির সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করলেও দুই শর্ত দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বেগম জিয়ার বোন প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা তার দ- স্থগিত হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
২৫ মাস সাজা ভোগের পর এমন এক সময়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত এলো যখন নভেল করোনা ভাইরাসের মহামারীতে বিশ্বজুড়ে চলেছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকারি হিসাবে ৪ জন মারা গেছেন। প্রেক্ষিতে নানা বিধিনিষেধে দেশ কার্যত লকডাউন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, কারা তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া ‘করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছেন’ এমন শঙ্কা থেকে তাকে আকস্মিকভাবে মুক্তি দিচ্ছে সরকার। কারাগারে তিনি করোনা আক্রান্ত হলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যে বিবেচনায় জামিন দেওয়া হয়েছে তা অনেক আগেই দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু তখন তা আমলে নেয়নি সরকার ও আদালত। অবশ্য, একদিন আগে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরাও বলেছিলেন কারাগারে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে আছেন বেগম জিয়া।
দলীয় প্রধানের দ- স্থগিত হওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। তার মুক্তির খবর চাউর হওয়ার গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার মুক্তির অপেক্ষায় অসংখ্য নেতাকর্মীর ভিড় দেখা যায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদ- নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি খালেদা জিয়া। তাকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ কারাগার স্থাপন করে সেখানে রাখা হয়। গত বছরের এপ্রিল থেকে তিনি বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন। সেখানে তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ এনে এ সময়কালে অনেকবারই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। কিন্তু সেসব আবেদনে আদালতের সায় মেলেনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, বৈঠকে-আলোচনায় বরাবরই বলে আসছিলেন, সরকার চাইলেই শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছিলেন, তার জামিনের এখতিয়ার আদালতের হাতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের করার কিছু নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে চলতি মার্চ মাসের শুরুতে খালেদার জিয়ার সম্মতিতে তার সাময়িক মুক্তি চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের করা এ আবেদনের তিন সপ্তাহ পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এর উপধারা ১ ধারা অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার সাজার কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়েছে। তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়ার সুপারিশ পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় যখন মুক্তি দেবে, তখনই তা কার্যকর হবে।
বাসায় রেখে চিকিৎসার শর্তের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে কিন্তু বলা হচ্ছে না যে, হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। হাসপাতালে ভর্তির বিষয়টি পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। সে জন্যই বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, হাসপাতালে যদি ভর্তি হতে হয়, তা হলে বলব, দেশের সবচেয়ে মানসম্পন্ন হাসপাতালেই তো তিনি আছেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে কি নাÑ সেটা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যাবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, ঢাকায় নিজ বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। ওই সময় দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে (করোনা পরিস্থিতি) কাউকে বিদেশে পাঠানো মানে তাকে সুইসাইড করতে বলা। তিনি জানান, কিছুদিন আগে খালেদা জিয়ার ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি দরখাস্ত এবং আমার কাছে একটি দরখাস্ত করেছিলেন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়ার জন্য। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা করানোর কথা। খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম, ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেখানেও ওই আবেদনের বিষয়ে তারা কথা বলেছিলেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম এস্কান্দার দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করেন, ‘নো কমেন্ট’। আর সেলিমা ইসলাম মুক্তির সিদ্ধান্তে সরকারকে ধন্যবাদ জানালেও বলেন, এখনো সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
খালেদা জিয়া কখন মুক্তি পাচ্ছেন? এ প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু সাংবাদিকদের বলেন, আইন মন্ত্রণালয় থেকে তার মুক্তি সংক্রান্ত নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন আইন দেখে কাগজপত্র তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদনের পর ফের সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফিরে আসবে। এর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে কারাগারে কাগজপত্র পাঠানো হবে। এরও পর কারা কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহীদুজ্জামান গতকাল বলেন, আশা করি আগামীকাল (আজ বুধবার) দুপুরের মধ্যেই খালেদা জিয়ার মুক্তির আইনি প্রক্রিয়াগুলো শেষ হবে।
এদিকে বিএনপি নেত্রীর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেনÑ এমন খবর তারা কয়েকদিন ধরেই শুনছিলেন। তাই গুলশানের বাড়িটি ইতোমধ্যেই সাফসুতরো করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মোট ৩৭টি মামলার মধ্যে ৩৫টিতেই তিনি জামিনে আছেন। আইনগতভাবে তার কারামুক্তির জন্য দ-প্রাপ্ত দুটি মামলায় জামিনের প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের সাজা বাড়িয়ে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে আপিল করেন খালেদা জিয়া। ওই আপিলের সঙ্গে তার একটি জামিনের আবেদনও দেওয়া হয়। এ মামলায় নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদ- দিলেও দুদকের সাজা বাড়ানোর আবেদন গ্রহণ করে হাইকোর্ট তাকে ১০ বছরের কারাদ- দেন। এ রায় বাতিল ও খালাস চেয়ে খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে আপিল করেন। সেই আপিল ও জামিনের আবেদন এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন গত ১২ ডিসেম্বর খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। পরবর্তীতে এ মামলায় আবারও জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। শুনানি নিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় করা আবেদনও খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এ কারণে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার জামিনের বিষয়ে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। তারা সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন।
৩৭টি মামলার মধ্যে ৫টি মামলা দায়ের হয় ওয়ান-ইলেভেন খ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগে। এগুলো হলো- জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লার খনি দুর্নীতি মামলা। এগুলোর মধ্যে দ-প্রাপ্ত দুটি ছাড়া অন্যগুলোর বিচার চলছে ঢাকার বিভিন্ন বিশেষ জজ আদালতে। বাকি ৩২টি মামলা বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে হয়। যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি ও ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে করা এসব মামলার মধ্যে ৩টি হয়েছে কুমিল্লায়, ২টি নড়াইলে এবং বাকি ২৭টি ঢাকায়। ৩৭ মামলার মধ্যে ১৮টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে। এ ছাড়া কিছু মামলা তদন্তাধীন ও কিছু মামলার বিচার চলমান।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার রায় হলে সেদিনই খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়।
নেতাকর্মীদের জমায়েত না হওয়ার আহ্বান
বিএনপির পক্ষ থেকে গতকাল দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানানো হয়েছে, তারা যেন বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালের সামনে ও গেটের ভেতরে জমায়েত না হন। কারণ এতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে খালেদা জিয়াসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের এবং জমায়েতকারীদের। নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনায় এবং করোনার মরণ ছোবল থেকে দেশবাসীসহ বিশ^বাসীকে রক্ষায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে।
Comment here