বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সাফল্যের গল্প - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সাফল্যের গল্প

গত ২১ মার্চ ২০২২ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি মিস ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড-রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগের সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ পরিদর্শন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সংক্রমণ ঘটায়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০। এর পর গত দুই বছরের ইতিহাস সবারই জানা। ২০২০ সালের শেষের দিকে বিশ্বের প্রায় ৩০০ টিকা প্রস্তুতির কার্যক্রমের মধ্যে মাত্র ১৬টি টিকাকে করোনা প্রতিরোধে প্রয়োগের জন্য অনুমোদন প্রদান করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সংকল্পবোধের কারণে বাংলাদেশ বহুবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও টিকা প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য অগ্রিম চুক্তির মাধ্যমে টিকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। এ টিকার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে তিনটি উচ্চপর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়। প্রথমটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি। দ্বিতীয় কমিটি গঠন করা হয় মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং কমিটি; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) নেতৃত্বে গঠিত হয় কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি। সারাদেশের কোভিড-১৯ টিকার সফল প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও কমিটি গঠন করা হয়। জেলা সদর আসনের সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা করে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে জেলা কমিটি এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার সমন্বয়ে উপজেলা কমিটি। এ কমিটিসমূহ প্রথমত মহামারী মোকাবিলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখসারির কর্মী, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন বয়োজ্যেষ্ঠ ও রোগাক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি; নিজ নিজ জেলা ও উপজেলাসমূহে করোনা টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ এবং টিকা কার্যক্রম চলাকালে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছিল কমিটিসমূহের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান সাফল্যের অন্যতম দাবিদার বিশ্বমানের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’। কোভিড-১৯ অতিমারী যুদ্ধে ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম সফটওয়্যার সমরাস্ত্র ছিল এটি। প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি ‘সুরক্ষা’ অ্যাপসটি উন্মুক্ত করেন। ২৭ জানুয়ারি ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্স ও একজন চিকিৎসকের দেহে প্রথম টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি উদ্বোধন করেন এবং ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখ থেকে ‘সুরক্ষা’ অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে দেশব্যাপী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি আরম্ভ হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগ এবং প্রায় কোনো অর্থ ব্যয় ছাড়া উদ্ভাবিত এ ‘সুরক্ষা’ অ্যাপস ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ১২ বছর এবং তদোর্ধ্ব বয়সের নাগরিকগণকে এর আওতায় আনা হয়। টিকা প্রদানে দ্রুততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। এ সিস্টেমের মাধ্যমে নাগরিকগণ ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিবন্ধন, টিকাকার্ড সংগ্রহ, ভ্যাকসিন গ্রহণের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ এবং ভ্যাকসিন সনদ গ্রহণ করার যাবতীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং জন্মসনদ যে কোনো একটি ব্যবহারের মাধ্যমে টিকাপ্রাপ্তির অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা রাখা হয়, যার ফলে প্রবাসীগণের জন্য বা বিদেশ ভ্রমণেও এটি সহায়ক ভূমিকা রাখে।

 

এই অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী, বিদেশগামী ছাত্রছাত্রী এবং বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকগণ টিকা গ্রহণের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। স্বাস্থ্য, পররাষ্ট্র, শিক্ষা, সমাজসেবা ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাপনার সর্বোত্তম ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম সেরা কোভিড ভ্যাকসিনসমূহের প্রায় সবগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে। মূলত চারটি প্রক্রিয়া কোভিড ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। যথা- আরএনএ ভ্যাকসিন, প্রোটিন ভ্যাকসিন, লাইভ এটিনিউয়েটেভ ভ্যাকসিন এবং ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন প্রমুখ। বাংলাদেশে এর সবগুলো যেমন- আরএনএ ভ্যাকসিন (ফাইজার ও মডার্না), ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন (অ্যাস্ট্রোজেনিকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন), লাইভ এটিনিউয়েটেড (সিনোফার্ম ও সিনোফার্ম) প্রমুখ ব্যবহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পৌনে তেরো কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ, সাড়ে ৯ কোটি জনকে দ্বিতীয় ডোজ, ৭০ লাখের কাছাকাছি মানুষকে বুস্টার ডোজ প্রদান করা হয়েছে। ১২-১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় দুই কোটি ডোজ প্রদান করা হয়েছে, প্রায় ২০ লাখ ভাসমান জনগোষ্ঠীকেও ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে। সুরক্ষা অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে টিকা ব্যবস্থাপনায় আনার পর প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে ভাসমান, নিম্নআয়ের মানুষ, গর্ভবতী ও স্তনদানকারী নারী, স্কুল-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকেও কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনতে তিন পর্বে সফল গণটিকা কার্যক্রম পালিত হয়েছে। প্রথমবার সারাদেশে গণটিকা প্রদান, দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ৭৫ লাখ টিকা প্রদান এবং সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একদিনে এক কোটি টিকা প্রদানে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে বাংলাদেশ। এসব কর্মসূচিতে নিয়োজিত জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিনিধি, এনজিওকর্মী, আনসার-ভিডিপি, স্কাউট, গার্লস গাইড, স্থানীয় ক্লাব, সাংবাদিক, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করাতে পিছিয়ে পড়া এবং বিভিন্ন কারণে টিকার আওতা থেকে বাদপড়া জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষকে প্রথম ডোজের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং ৫৫ শতাংশ মানুষ পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে। আগামী মাসে অর্থাৎ এপ্রিল মাসের মধ্যে বাংলাদেশ শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। তার জন্য ১৭-৩১ মার্চ পর্যন্ত গণটিকা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য-উপাত্তে প্রমাণ মিলেছে যে, সফল ভ্যাকসিন কর্মসূচির কারণেই বাংলাদেশে ওমিক্রনের ঢেউ সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ যেখানে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও ভ্যাকসিন কর্মসূচি সফল করতে হিমশিম খেয়েছে; নানাবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও করোনা প্রতিরোধ এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগে বাংলাদেশের সফলতা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। সবচেয় বড় কথা- জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য সারাবিশ্বে নিদর্শন হয়ে থাকবে।

লেখক : লেখক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা

Comment here