‘বেপরোয়া চলাচল বাড়াবে করোনা’ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

‘বেপরোয়া চলাচল বাড়াবে করোনা’

আফরিন আপ্পি : শুক্রবার। বিকেল পাঁচটা। রাজধানীর হাতিরঝিলের রামপুরা, মধুবাগ, গুলশান ও মহানগর প্রজেক্ট সংলগ্ন ব্রিজগুলো লোকে লোকারণ্য। চলছে জমজমাট আড্ডা। সেইসাথে সিগারেটের ধোঁয়ায় গিটারে উঠেছে গানের সুর। এত সংখ্যক লোক দেখে বোঝার উপায় নেই দেশে মহামারি করোনা বলে কিছু আছে। শুধু রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা নয়, চন্দ্রিমা উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র সরোবর, ধানমন্ডি ৩২ সহ সব বিনোদনকেন্দ্রর চিত্র এটি।

সরেজমিনে এসব বিনোদন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না কেউ। সবকিছু ভুলে আড্ডা, হাসি-আনন্দে মেতে উঠেছে সবাই বিনোদনকেন্দ্রে আসাদের বেশিরভাগের মুখে মাস্ক নেই‌। যাদের রয়েছে তাও আবার থুতনিতে। নেই কোনো সামাজিক দূরত্বের বালাই। যেখানে সেখানে বসে যত্রতত্র জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন সবাই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের এই বেপরোয়া চলাচল করোনার সংক্রমণ আরও বাড়াবে। করোনা দীর্ঘায়িত হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা। আর সচেতন হলে আমরা ভ্যাকসিন থেকে বেশি সুফল পেতে পারি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে এই বেপরোয়া চলাচলের কারণ কী? কেনই-বা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না কেউ? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, উত্তরা থেকে দুই শিশু নিয়ে হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা গৃহিণী রানু বেগম বলেন, ‘বেড়াতে এসেও যদি মাস্ক পরতে হয় তাহলে আর বাইরে আসা কেন! এখানে এসেছি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে, সে কারণেই মাস্ক খুলে রাখা।’

রানু বেগমকে পেছনে ফেলে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন ছয়-সাত জন যুবক। তাদের মধ্যে বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত জুবায়ের আহমেদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছি অনেক। কিন্তু এখন আর মানতে ইচ্ছে করে না। মাস্ক পরাটা একটা বিরক্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখন কারও মধ্যে সেভাবে মেনে চলার প্রবণতাও দেখছি না।’ পাশেই বসে থাকা রাসেল নামে আরেক যুবক বলেন, ‘মাস্ক পকেটে আছে। বাড়ি যাওয়ার সময় পরে যাব।’

স্বাস্থ্যবিধি মানতে এত উদাসীনতার কারণ কী; প্রশ্ন করা হলে সিনথিয়া নামে এক তরুণী জানান, দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দী থাকতে থাকতে হাঁসফাঁস অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তাই এখন বেড়াতে এসেছেন। এই তরুণীর দৃঢ় বিশ্বাস করোনা তার কিছুই করতে পারবে না।

হাতিরঝিলের ভাসমান রেস্টুরেন্টগুলোর প্রতিটিতেই দেখা গেছে মানুষের ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি সেখানকার খাবার ব্যবসায়ীদেরও। খাবারের দোকানগুলোর আশেপাশে গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, খাবার খাচ্ছেন সেখানে আগতরা। এরই মাঝে বন্ধুরা মিলে জন্মদিনের কেক কাটাসহ চলছে নানাবিধ উৎসব।

এদিকে সন্ধ্যায় ফুচকা, চটপটি, লুচি আর কাবাবের ঘ্রাণে মাতোয়ারা ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর এলাকা। খাবার টেবিলগুলোতে নেই তিল ধারণের জায়গা‌। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রুবেল নামে এক খাবার ব্যবসায়ী জানান, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার পরিবেশন করতে চাইলেও ক্রেতাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে উদাসীনতা। কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে চাইছেন তারা এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এই ব্যবসায়ী।

জুয়েল নামে আরেক দোকানি জানান, ক্রেতারা খাবার টেবিলে বসার আগে তাদের সবাইকে বারবার হাত ধুয়ে বসার আহ্বান জানান তিনি এবং চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব দূরের চেয়ার-টেবিলে বসাতে। তবে বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে আসায় আলাদা বসতে বলেল তারা বলেন, ‘আমরা একসাথে এসেছি একসাথে বসবো।’ সেক্ষেত্রে কিছুটা কঠিন হয়ে যায় স্বাস্থ্যবিধি মানানো। এমনকি তাদের অনুরোধ করা হলে অনেকসময় বিরক্ত হয়ে অন্য দোকানে চলে যান।

কয়েকদিন এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হাওয়ায় এখন আর কিছুই বলেন না বলে জানান এই দোকানি। বিক্রেতারা সেখানে হাত ধোয়াসহ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা জানালেও চোখে পড়েনি তেমন কিছুই।

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে বেড়াতে আসার কারণ জানতে চাওয়া হলে, রবীন্দ্র সরোবরে আসা মিরপুরের বাসিন্দা রিগান বলেন, ‘এখন তো আর করোনা নেই। সেজন্যই এসেছি। মুখে মাস্ক দিয়ে রাখলে নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। পকেটে মাস্ক আছে মাঝে মাঝে পরি।’ রিগানের সঙ্গে থাকা বন্ধু অপু বলেন, ‘মুখে মাস্ক থাকলে আশেপাশের কেউ কথা বুঝতে পারে না। তাই মাস্ক খুলে রেখেছি।’

নাইমা নামের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, এখন আর করোনা সেভাবে নেই। আগে যেমন সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক ছিল এখন সেটা কেটে গেছে। সেজন্য এখন আর অত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয় না। আর মাস্কও সেভাবে পরা হয় না।

মানুষের এই বেপরোয়া চলাচল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হিউম্যান এইড বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. শেখ মইনুল খোকন বলেন, ‘শহরের মানুষ তাদের পূর্বের ব্যবসা, বিনোদন, ব্যস্ততায় ফিরে যাচ্ছে। মানুষজন আগের মতো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া, শপিং করার মতো জনসমাগমে মিলিত হচ্ছে। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই তাহলে বিশ্বে যেটি বিরল; সেই পুনরায় আক্রান্তের ঘটনা আমাদের দেশে খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে।’

বিশ্বে যেখানে পুনরায় আক্রান্তের সংখ্যা তিন সংখ্যায় পৌঁছেনি সেখানে আমাদের দেশে হাজার কিংবা লাখের সংখ্যা ছুঁয়ে গেলে সেটি খুব অস্বাভাবিক বলে মনে হবে না। এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কিছু রোগ মানুষ থেকে মানুষে হাঁচি, কাশি, বায়ুফোটার মাধ্যমে ছড়ায়। কিন্তু করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের স্পর্শ করা পৃষ্ঠতলসহ সম্ভাব্য সকল মাধ্যমে ছড়াতে পারে। সে কারণে এটি অতি সংক্রামক রোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।’

দেশের একটি ল্যাবের এই মাসের ২২ ও ২৩ তারিখে করা ২ হাজার ২০০ এর অধিক সংখ্যক নমুনা পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে মোটের ওপর ১১.১৪ শতাংশ নমুনা পজিটিভ হচ্ছে। ঢাকা শহরে ক্ষেত্রবিশেষে সেটি ১১.৪২ শতাংশ থেকে ৩৬.২৬ শতাংশ পজিটিভ। একই ল্যাবের ১৯, ২০, ও ২১ তারিখ এর নমুনা পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে মোটের ওপর ১২.৬৩ শতাংশ নমুনার ফলাফল পজিটিভ। সেখানে ঢাকার বাহিরের দুটি জেলার ফলাফল যথাক্রমে ৫.২৬ শতাংশ থেকে ১১.৩৮ শতাংশ পজিটিভ হয়েছে।

ঢাকার বাইরের তুলনায় ঢাকার ভেতরে নমুনার ফলাফল বেশি পজিটিভ আসার কয়েকটি ব্যাখ্যা হতে পারে মন্তব্য করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঢাকার বাইরের তুলনায় ঢাকার তথা শহরের মানুষ বেশি সচেতন। শহরের মানুষের জন্য নমুনা পরীক্ষা আপেক্ষিকভাবে সহজ বলে বেশি পরীক্ষার কারণে বেশি পজিটিভ হচ্ছে।’

জনগণের এই বেপরোয়া চলাচল রুখতে প্রশাসন কতটা তৎপর জানতে চাওয়া হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাপ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করাতে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিষয়টি হলো, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ছাড়া কোনোভাবেই করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।’

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, ইউরোপের দেশগুলোতে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ মাস্ক না পরলে সেখানে লকডাউন দেওয়া হয়।স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে না চাইলেও লকডাউন আবার সবাই ঠিকই মানে। অনেক সময় এলাকাভিত্তিক লকডাউন করা হয় যেটি বাংলাদেশ সবসময় বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই মহামারির ব্যাপকতা কমাতে আমাদের উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, মাস্ক ছাড়া অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। মাস্ক পরে না আসলে কোন ধরনের সেবা না দেওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে এ বিষয়ে মাইকিং করা হচ্ছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। মাস্ক বিতরণ করছি এবং জরিমানা করছি‌।’

 

Comment here