‘লাভজনক বিমান’ ৩৪৪৯ কোটি টাকা ছাড় চায় - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

‘লাভজনক বিমান’ ৩৪৪৯ কোটি টাকা ছাড় চায়

গোলাম সাত্তার রনি : নিজেদের লাভজনক প্রতিষ্ঠান দাবি করলেও দেনার দায়ে জর্জরিত ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’। গত মাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা মওকুফের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বিমান কর্তৃপক্ষ। তাদের সেই ‘আবদার’ মেনেও নেয় মন্ত্রণালয়। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এই আবদার মানতে রাজি নয়।

গত ১৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ‘বিমান এখন লাভে আছে। বছরে বিমানের টিকিট বিক্রি করে আয় হয় ৭ হাজার কোটি টাকা। আর এক হাজার কোটি টাকা আসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা থেকে। তিন মাসের তুলনামূলক চিত্রে বিমানে রাজস্ব আয় বেড়েছে ৮১৭ কোটি টাকা।

এ ঘোষণার মাসখানেক আগে কোভিড মহামারীর দোহাই দিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে সারচার্জ বাবদ দেনা ৩ হাজার ৪৪৯ হাজার কোটি টাকা মওকুফের আবেদন জানায় বিমান কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া পুঞ্জীভূত বকেয়ার ওপর প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন জানায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বরাবর। তাদের এই ‘আবদার’ মেনেও নেয় মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২০ অক্টোবর বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উপসচিব। তবে মন্ত্রণালয়ের এই ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ আপাতত মেনে নিতে পারছে না বেবিচক কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে কোন পথে এগনো যায়, এ নিয়ে বৈঠক করবে বেবিচক। গতকাল বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

গত ২০ অক্টোবর বেবিচক চেয়ারম্যানের দপ্তরে মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়, বেবিচকের কাছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের দেনার পরিমাণ ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল পাওনা ৯৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা; ভ্যাট ও ট্যাক্স ৩৪২ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং সারচার্জ বাবাদ ৩ হাজার ৪৪৯ দশমিক ১৪ কোটি টাকা। বেবিচক কর্তৃক দাবিকৃত পুঞ্জীভূত বকেয়ার ওপর সারচার্জ (প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে) মওকুফ করার বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অনুরোধ করেছে। এমতাবস্থায় বেবিচক কর্তৃক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের কাছে আরোপিত সারচার্জ ৩ হাজার ৪৪৯ দশমিক ১৪ টাকাসহ পুঞ্জীভূত বকেয়ার ওপর প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে সারচার্জ মওকুফ করার জন্য ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ করা হয়।

এই চিঠি বেবিচকে পাঠানোর ৩৬ দিন আগেই মন্ত্রণালয়ের কাছে মূল দেনার ওপর আরোপিত সারচার্জ মওকুফ প্রসঙ্গে আবেদন করেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. যাহিদ হোসেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বেবিচক কর্তৃক দাখিলকৃত সকল প্রকার ল্যান্ডিং, পার্কিং, নেভিগেশন বিলসমূহ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড ২০১৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্যাসেঞ্জার টিকিটের সঙ্গে সংগৃহীত আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ এম্বারকেশন ফি, বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি এবং যাত্রী নিরাপত্তা ফি নিয়মিতভাবে বেবিচককে পরিশোধ করে আসছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বিমান করপোরেশন ও সিভিল এভিয়েশনের দেনা-পাওনার হিসাব করা হয়। ওই সময় বেবিচক কর্তৃক আরোপিত সারচার্জ ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মওকুফ করা হয় এবং মূল বিল বাবদ পাওনা অর্থ ৫৭৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা সরকারের ইকুইটিতে স্থানান্তর করে সিএএবি এর পাওনা সমন্বয় করা হয়।

কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অসম প্রতিযোগিতা, উড়োজাহাজের স্বল্পতা, পুরনো উড়োজাহাজ বহর থেকে সরানো ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পূর্বের বকেয়া অর্থ সিএএবিকে পরিশোধ করা বিমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে পূর্বের বকেয়া অর্থ ইকুইটি খাতে স্থানান্তরের বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়, যা বিবেচনাধীন রয়েছে। বর্তমানে বেবিচকের কাছে বিমানের দেনার পরিমাণ ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল পাওনা ৯৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা; ভ্যাট ও ট্যাক্স ৩৪২ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং সারচার্জ বাবাদ ৩ হাজার ৪৪৯ দশমিক ১৪ কোটি টাকা। বিমান ইতিপূর্বে কক্ষ/জায়গা ভাড়া, জমির ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও পানি বিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করে আসছিল। কিন্তু পরে বেবিচক ও বিমান কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে জায়গার পরিমাপ নির্ধারণ ও নতুন চুক্তি সম্পাদন করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বিধায় বিমানের কক্ষ/জায়গা ভাড়া এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ভ্যাট ও আয়করের (৩৪২ কোটি ১৭ লাখ টাকা) বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিধায় ভ্যাট ও আয়করের দেনা অপরিশোধিত রয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে- ‘বেবিচক এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। বিমান দেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে ব্যবসা করে। করোনাকালে বিমান চীনের উহান এবং অন্যান্য দেশ থেকে প্যাসেঞ্জার (শ্রমিক-শিক্ষার্থী) ও জরুরি পণ্য পরিবহন করে। এ ছাড়া চীন থেকে কার্গো ফ্লাইটের মাধ্যমে করোনা ভ্যাকসিন আনা এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ইউএন মিশন ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এসব বিলের অর্থ বকেয়া রয়েছে। এমতাবস্থায় বেবিচক কর্তৃক দাবিকৃত পুঞ্জীভূত বকেয়ার ওপর সারচার্জ (প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে) মওকুফ করে, করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে জাতীয় পতাকাবাহী বিমানকে আর্থিক কার্যক্রমে আরও গতিশীলতা আনায়নের বিষয়ে সহযোগিতা প্রয়োজন। অতএব বেবিচক কর্তৃক আরোপিত সারচার্জ মওকুফ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

বকেয়া মওকুফের বিষয়ে বিমানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. যাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিমানের কাছে বেবিচক যে টাকা পাবে, তার কিছু অংশ মওকুফের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছি। তবে এখনো আমরা আবেদনের বিষয়ে বেবিচক থেকে কোনো সাড়া পাইনি। আমাদের দেনার টাকা কিস্তি আকারে করে দিলে ধাপে ধাপে পরিশোধ করে দেব।’

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বেবিচকের বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে উদাসীন বিমান কর্র্তৃপক্ষ। তারা যে সারচার্জ মওকুফ চাচ্ছে, সেই সারচার্জের জন্য ভ্যাট প্রদান করছে বেবিচকই। প্রতি মাসে বিমানের কাছে বেবিচকের বিল থাকে গড়ে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকা। কিন্তু কোনো মাসেই তারা চলতি বিলের পুরোটা পরিশোধ করে না, পুরনো পাওনা তো দূরের কথা। তাই আপাতত বকেয়া মওকুফের সুযোগ দেখছে না বেবিচক।

 

Comment here