নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের এক সংকটময় সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে খোলা চিঠি লিখেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে কর্মরত এক সিনিয়র স্টাফ নার্স।
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল নামের ওই নার্স একাধারে বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব এবং ঢামেক শাখার সাধারণ সম্পাদক।
১২ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরে ওই খোলা চিঠি লেখেন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল। সেগুলো দ্রুত কার্যকর করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
খোলা চিঠির শুরুতে ওই নার্স লেখেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নার্সিং সেক্টরের যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে এবং নার্সরা যতটুকু মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন তার প্রায় সবটুকুই আপনার অবদান। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্ব যেখানে আক্রান্ত এবং প্রিয় বাংলাদেশেও সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তাই উপায়ান্তর না পেয়ে আজ এ খোলা চিঠি লিখতে হচ্ছে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন অথবা কোনো অনুষ্ঠানে আপনার কাছে গিয়ে সরাসরি নার্সদের পক্ষ থেকে আপনাকে কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ অথবা পেশায় নিয়োজিত নার্সদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, তিরস্কার, অবমাননা, অপমান এবং আপনার কাঙ্ক্ষিত সেই নার্সিং সার্ভিসটি বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যা ও সমাধানের প্রস্তাবনা দেওয়ার সৌভাগ্য হয় না, যেমনটি অন্যান্য পেশাজীবী নেতাদের রয়েছে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সারা দেশের নার্সরা জীবন ঝুঁকি নিয়েও সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য তৈরি হয়ে আছেন। তাই একজন নার্স হিসেবে এবং নার্সদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে এই দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে নানাবিধ বৈষম্য, প্রতিকূলতা ও অসহায়ত্ব নিয়ে আজ কিছু জিজ্ঞাসা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।
কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাবনাসমূহ
১. চিকিৎসক সমাজের বর্তমান ও সাবেক নেতারা অভিযোগ করছেন যথা সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ছিল। তারা মনে করছেন চিকিৎসক প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের যথা সময়ে এ দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মপন্থা তৈরিতে সম্পৃক্ত না করার কারণে আজ সব এলোমেলো মনে হচ্ছে। এখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে আমারও প্রশ্ন হলো, বিভিন্ন পলিসি মেকিং সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ কেন নার্সনেতা বা নার্সিং বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করছেন না? খবরে দেখছি এতগুলো ভেন্টিলেটর, এতগুলো পিপিই, আরও কতশত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু একবারও ভাবা হচ্ছে কি এই ভেন্টিলেটরগুলো সার্বক্ষণিক যে নার্সরা পরিচালনা করবে, এর সাথে মনিটরগুলো যে নার্সরাই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবে এবং যে নার্সদের হাতেই রয়েছে এ দুর্যোগে সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বেশি কর্মকাণ্ড, সেই নার্সদের প্রতিনিধি বা এক্সপার্টদের অদ্যবধি কোনো পলিসি মেকিং সভায় আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না কেন? কেউ ভেবেছেন কি সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে যে নার্সদের হাতেই রয়েছে জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে সর্বোচ্চ সেবা বা আন্তরিকতা পাওয়ার ইচ্ছা, তাদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে তাদের কাছেও থাকতে পারে ভালো এবং সবার জন্য মঙ্গলজনক কোনো পরামর্শ ও প্রস্তাবনা।
করোনাভাইরাস মহামারিতে ইউরোপ-আমেরিকা যেখানে আজ অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে, সেখানে আমার দেশের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিরা এখনো দাম্ভিকতা পরিহার করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করছেন না কেন? সময় যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ না করুন যদি ওইসব দেশের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয় আপনারা-আমরা তখন কী করে বাঁচব ভেবে দেখেছেন কি? তাই দেশের মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সকল পলিসি মেকিং সভায় নার্স প্রতিনিধি ও নার্স বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরি মনে করছি এবং এ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
২. সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত আইসিইউতে যতগুলো ভেন্টিলেটর আছে বলে হিসাব দেওয়া হচ্ছে তার প্রকৃত সংখ্যা এবং কতগুলো সচল আছে তা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? প্রতিটি ভেন্টিলেটর ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনা করে তা সচল রাখতে কতগুলো সার্কিট লাগবে? করোনা রোগীকে ব্যবহার করা সার্কিট পুনঃব্যবহারের কোনো পদ্ধতি আছে কি না? কতগুলো ইটিটি লাগবে? সংক্রমিত করোনা রোগীর ভেন্টিলেটর সচল রাখতে কী পরিমাণ সাকার টিউব প্রয়োজন? ভেন্টিলেটর পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কার্ডিয়াক মনিটর সচল রাখতে কী পরিমাণ সরঞ্জাম লাগবে? কী পরিমাণ অক্সিজেন, নাইট্রাস গ্যাস ও নেগেটিভ ভ্যাকুয়াম প্রেশার লাগবে? এসব অতি প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য কতজন স্পেশালাইজড নার্স তৈরি করা হয়েছে? অন্য কোনো ডিসিপ্লিনের পিএইচডি অর্জনকৃত কোনো ব্যক্তিকে যদি একটা আইসিইউ রোগীকে ম্যানেজ করতে বলা হয় তার কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কারণ এখানে রোগী নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার কোনো সুযোগ নাই। তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক ও মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন নার্স দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি যেকোনো রোগীর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য মানসিকভাবেও তৈরি হন। যা নার্সরা ভালোভাবেই তৈরি হয়ে আছেন।
চিকিৎসকরা আজ অভিযোগ করছেন, তাতে সরকার বা জনগণের লাভ কী হচ্ছে? কাল যখন আমরাও একই সত্য অভিযোগ করব, হয়তো আমাদের দায়মুক্তি হবে। কিন্তু দেশ, সরকার ও জনগণের কি কাজে আসবে? তাই স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত সকল পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।
৩. লাখ লাখ পিপিই সংগ্রহ ও বিতরণের প্রতিবেদন আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখছি। কোথায় কোন প্রতিষ্ঠানে কতগুলো পিপিই বিতরণ করা হয়েছে তার সংখ্যাটা প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নার্সগণ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ পিপিই চাইতে গিয়ে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও তিরষ্কৃত হয়েছেন। বদলির ভয়, বেতন বন্ধ করার ভয়সহ নার্সদের কেন দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও আপত্তিকর ও অশালীন মন্তব্য শুনতে হচ্ছে।
প্রত্যেক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় করোনা দুর্যোগ মোকাবিলার গাইডলাইন জানানো হচ্ছে না কেন? কেন এসব বিষয়ে সবার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও দূরত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে? আর যে পিপিই বিতরণের ছবি আমরা গণমাধ্যমে দেখছি তা কতটা নিরাপদ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, সংক্রমিত ও সংক্রমণযোগ্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এন ৯৫ মাস্কসহ কমপ্লিট পিপিই যেসব প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে তা প্রকাশ করা জরুরি। এ ভাইরাস অন্য দেশের জন্য যেমন বিপদজনক তেমনি আমাদের জন্যও। তাই বেঁচে থেকে চিকিৎসাসেবা নির্বিঘ্ন রাখতে অবশ্যই সংক্রমিত রোগীদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কমপ্লিট পিপিই পরিধান আবশ্যক যা আপনার সদয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
৪. দিনের ২৪ ঘণ্টা রোগীদের কাছে থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রধান ভূমিকা রাখছেন নার্সরাই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে আপনি বলেছেন, সবার আগে নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারপরও নার্সরা সুরক্ষা সরঞ্জাম চাইতে গিয়ে হেনস্তা হচ্ছেন কেন? একই প্রতিষ্ঠানের একই ওয়ার্ডে কেউ সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিধান করে রোগী দেখছে অথচ ওই রোগীদের আইভি ক্যানুলা, ইনজেকশন দেওয়া, অক্সিজেন দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো— সবই নার্সদের করতে হচ্ছে অরক্ষিত অবস্থায়। যা অত্যন্ত অমানবিক এবং নার্সদের প্রতি বৈষম্যের হীন বহিঃপ্রকাশ। এই দুর্যোগে সকল বৈষম্য পরিহার করে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। নয়তো যেসব স্বাস্থ্যকর্মী অরক্ষিত থাকবেন তারা আক্রান্ত হলে প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীই হয়ে উঠবেন করোনাভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম। বাঁচবে না তখন সেই সুরক্ষা পোশাক পরিহিত কর্মকর্তারাও। তাই সুরক্ষা সরঞ্জামের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে আপনার সদয় হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।
৫. সারা দেশব্যাপী আইসোলেশন সেন্টার বা ইউনিট বা ওয়ার্ডগুলো পরিচালানার জন্য ডিউটি শিফট, কোয়ারান্টাইন পিরিয়ড, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা এবং আক্রান্ত হলে চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থাসহ সকল বিষয়ে অভিন্ন নিয়ম, অনুশাসন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। এই লকডাউন পরিস্থিতিতে আইসোলেশন সেন্টার বা ইউনিট বা ওয়ার্ডগুলোতে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ির মালিক কর্তৃক বিভিন্ন হেনস্তা থেকে মুক্ত রাখতে, যাতায়াত ও রাস্তায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মীদের শুধুমাত্র করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ইউনিট ও সেন্টারগুলোতে দায়িত্ব পালন করার কারণে বাসা ছেড়ে দেয়া এবং বের করে দেয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত অমানবিক। চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য হাসপাতাল কর্মীদের সুস্থ মানসিকতা নিয়ে সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছি।
৬. সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রটেক্টিভ গাউনের রঙ সাদা, যা সকল গবেষণাগারে গবেষক, চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, ভেটেরিনারি ও লাইভস্টকগণ, সকল ক্যাটাগরির মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মাঠপর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও পরিধান করছেন। এ দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী যে পিপিইগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর রঙও সাদা। কারণ জীবাণু প্রতিরক্ষায় সাদা রঙটাই বিজ্ঞানসম্মত ও সর্বজন সমর্থিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ দুর্যোগে যথাযথ পিপিই না দিতে পারলেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রশাসকরা অতি-উৎসাহী হয়ে নার্সদের শরীর থেকে সাদা অ্যাপ্রোন খুলে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন এবং নার্সদের খেপিয়ে তুলছেন যা আপত্তিকর। এসব বিষয়ে অতি-উৎসাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
৭. সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নার্স ও মিডওয়াইফারিদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারাবিশ্বেই সংকট থাকলেও বাংলাদেশে নার্স সংকট তীব্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত ১০ হাজার নার্স, পাঁচ হাজার মিডওয়াইফসহ আরও ১০ হাজার নার্স অর্থাৎ সর্বমোট ২৫ হাজার নার্সকে বিশেষ বিবেচনায় প্রয়োজনে বয়স পরিমার্জনসহ নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করে দ্রুত নিয়োগ দিয়ে এই করোনাযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া এখন সময়ের যৌক্তিক দাবি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সদয় বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ করছি।
৮. মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালগুলোতে বিদেশফেরত কিংবা সংক্রমিত হতে পারে— এমন তথ্য গোপন করে রোগী ভর্তি হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের শঙ্কা বাড়ছে। সন্দেহবশত পরীক্ষা এবং পজিটিভ রিপোর্ট আসার কারণে সংক্রমণ রোধে পুরো ইউনিটের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন নিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পুরো স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই একই সময় সবাইকে আক্রান্ত হওয়া বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখতে প্রত্যেকটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিভাগের ইউনিটগুলোকে একিভূত করে পর্যায়ক্রমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব পালন করানো অত্যন্ত জরুরি মনে করছি।
৯. এ মহামারি মোকাবিলায় অন্যতম সহযোদ্ধা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ ১০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। দেশের এই নগণ্য সংখ্যক টেকনোলজিস্ট দিয়ে করোনা পরীক্ষা হবে, না অন্য সাধারণ রোগীদের পরীক্ষা হবে— সেটা এখন দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ের সঠিক সমাধান করে জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
১০. সারা দেশব্যাপী রোগী ও মৃতদেহ পরিবহনের জন্য সচল অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়িচালকের স্বল্পতা রয়েছে। সংক্রমিত রোগী পরিবহন করে একজন চালক কোয়ারেন্টাইনে চলে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত জানার পর তা পরিবহনে দুই-তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়েও কোনো বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গাড়িচালকের এই সংকট মোকাবিলায় অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত সরকারি গাড়িচালকদের আপদকালীন এই সময়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ন্যাস্ত করে সারা বাংলাদেশের সকল আইসোলেশন সেন্টার এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া জরুরি বলে মনে করছি।
১১. নার্সিং প্রশাসনের সিস্টেমের জন্যই সকল স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত নার্স-কর্মকর্তাদের টেন্ডার দুর্নীতি, দামি মেশিন ক্রয়ে দুর্নীতির কোনো সুযোগ না থাকায় নার্সরা স্বাভাবিকভাবেই আত্মমর্যাদাশীল হয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। শতকরা ৯৫ ভাগ নারী সদস্য সংবলিত এ পেশায় অবজ্ঞা, অবমূল্যায়ন ও অবহেলার শিকার হয়ে পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার উপক্রম হয়। ঠিক তখনই আপনার বক্তব্যে নার্সদের জন্য কথা শুনে আবার প্রাণ ফিরে পায়। বিগত ২০১১ সালের নার্স সমাবেশ ব্যতীত স্বাস্থ্য সেক্টরের সকল অনুষ্ঠানে কোনো প্রতিনিধি বা বক্তা নার্সদের বিষয় একবারও উচ্চারণ না করলেও আপনি সকল অনুষ্ঠানে নার্সদের উন্নয়নের কথা ও কল্যাণের কথা বলতে ভুলে যাননি। নার্সদের প্রতি আপনার এই মহানুভবতা ও ভালোবাসাই বাংলাদেশে অনেক নার্সকে এ পেশায় টিকে থাকতে অনুপ্রাণিত করছে। একমাত্র আপনার ভরসায় আগামী দিনে নার্সদের প্রাপ্য অধিকার আদায় হবে, নার্সিং শিক্ষা ও শ্রমের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে— এমন আশায় বুক বেঁধে পেশাগত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আর আপনার পদক্ষেপের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। তাই নার্সিং প্রশাসনের বিদ্যমান নানাবিধ জটিলতা নিরসনে আপনার সদয় হস্তক্ষেপ একান্তভাবে কামনা করছি।
১২. করোনার ভয়াবহতা জেনেও অরক্ষিত অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানে নার্সগণ দায়িত্ব পালনে পিছু হটেনি। বৈষম্যের শিকার এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নার্সদের মনের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি বা কোনো রূপ কর্মসূচি দেয়নি। আমরা সবাইকে এই পরিস্থিতিতে যেকোনো কর্মসূচি পালনে নিরুৎসাহিত করেছি এবং আপনার নির্দেশনার অপেক্ষা করেছি।
সবশেষে সকল জেলার জেলা প্রশাসকদের সাথে টেলিকনফারেন্স অনুষ্ঠানে আপনি সবার আগে নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার নিদের্শনা দিয়েছেন। তাই আপনার এই নির্দেশনার আলোকে সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আইসোলেশন সেন্টার বা ইউনিট বা ওয়ার্ডগুলোতে কর্মরত সকল নার্সিং প্রশাসক, নেতৃবৃন্দদের অনুরোধ করছি, ঝুঁকিপূর্ণ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা ওয়ার্ডগুলোতে কর্মরত নার্সদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণে কোনোরূপ অনিয়ম ও বৈষম্য পরিলক্ষিত হলে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসাসিয়েশন (বিএনএ)-কে অবহিত করুন। অন্যদিকে এই দুর্যোগে যেন কোনো নার্সের দ্বারা কোনো সম্পদের অপচয় না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ারও অনুরোধ জানাচ্ছি।
Comment here