সাক্ষী থেকে আসামি ‘মিন্নিই ছিলেন মাস্টারমাইন্ড’ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

সাক্ষী থেকে আসামি ‘মিন্নিই ছিলেন মাস্টারমাইন্ড’

কবির হোসেন : আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি কি সত্যিই তার স্বামী শাহনেওয়াজ শরীফ ওরফে রিফাত শরীফকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন? নাকি তাকেই উল্টো ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে? রায়ে কি তিনি বেকসুর খালাস পাবেন? নাকি দোষী সাব্যস্ত হবেন? অনেকের মনে জাগা এসব প্রশ্নের সমাধান মিলেছে। রিফাত হত্যামামলার রায় হয়েছে গতকাল বুধবার। রায়ে মিন্নিকে মূল ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে তার মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে গত বছরের ২৬ জুন দিনের বেলা শত শত মানুষের সামনে

রিফাতকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেদিনই চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের একটি ভিডিও দেশব্যাপী ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়- রিফাতকে কোপানোর সময় তাকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তার স্ত্রী মিন্নি; হত্যাকারীদের উদ্যত অস্ত্রের মুখোমুখি হয়ে তিনি তাদের থামাতে চাইছেন। এ ভিডিও দেখার পর অনেকেই মিন্নির প্রশংসা করেন। ঘটনার পর আহত রিফাতকে তিনিই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। হত্যার পরদিন নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় প্রধান সাক্ষী করেন মিন্নিকে। কিন্তু মাত্র ২০ দিন পরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ১৬ জুলাই প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাকে হত্যাকা-ের মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আটক করে পুলিশ এবং গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর ৭ নম্বর আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। গতকাল এ মামলার রায়ে মিন্নির মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। রায়ের পর মিন্নিকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। আদালত তাকে এ হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড বা মূল পরিকল্পনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব বলা হয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম মজিবুল হক কিসলু সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি যে, রিফাত শরীফের হত্যাকা- মিন্নির কারণেই সংঘটিত হয়েছে। নয়তো এ হত্যাকা- হতো না। আর আদালত তার পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, মিন্নির পরিকল্পনায় এবং তার কারণেই এ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। হত্যার আগে মামলার মূল আসামি নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নি এক মাসে ৪৪ বার এবং নয়ন বন্ড মিন্নির সঙ্গে ১৬ বার ফোনে কথা বলেছেন। এ ছাড়া দুজন পরস্পরের মধ্যে অসংখ্যবার খুদে বার্তাও চালাচালি করেছেন।

মামলার তদন্তে নেমে একপর্যায়ে রিফাতের হত্যাকারী নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্কের প্রমাণ পান তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার ওসি (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির। রিফাত হত্যাকা-ে মিন্নি জড়িত- এমন অভিযোগ এনে ১৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন রিফাতের বাবা। পরদিন মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বরগুনায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের তথ্য গোপন, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়ন বন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা তথা রিফাত হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হত্যাকা-ের ২০ দিন পর ১৬ জুলাই মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর, যে মামলায় মিন্নি ছিলেন প্রধান সাক্ষী, সেই মামলায় তিনি হয়ে যান আসামি।

বরগুনা জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, মিন্নি তার স্বামী রিফাত হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাছাড়া মামলায় এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী, তার ভাই তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজী, ছয় নম্বর আসামি রাব্বি আকন এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, রিফাত হত্যায় নয়ন বন্ডের সঙ্গে পরিকল্পনায় ছিলেন মিন্নি। হত্যাকা-ের দুদিন আগে হেলাল নামে তার এক বন্ধুর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন রিফাত শরীফ। রিফাত শরীফের বন্ধু হলেও নয়ন বন্ডের খুবই ঘনিষ্ঠ হেলাল। তাই হেলালের ছিনিয়ে নেওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধারে নয়ন বন্ড দ্বারস্থ হয় মিন্নির।

নয়ন বন্ডের অনুরোধে হত্যাকা-ের দুদিন আগে রাতে সেই ফোন রিফাত শরীফের কাছ থেকে উদ্ধার করেন মিন্নি। কিন্তু এ ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে রিফাত শরীফের মারধরের শিকার হন তিনি। পরে হত্যাকা-ের আগের দিন নয়নের সঙ্গে দেখা করে মিন্নি সেই ফোন তার হাতে তুলে দেন। এ সময় মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফের হাতে যে মারধরের শিকার হয়েছেন তার প্রতিশোধ নিতে বলেন নয়নকে। এরপর ওইদিন বিকেলে বরগুনা কলেজ মাঠের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নয়ন বন্ড ও তার বাহিনীর সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারধরের বিষয়ে সভা করেন মিন্নি। রিফাত শরীফকে হত্যা করার আগে তো বটেই, পরেও নয়ন বন্ডের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে মিন্নির।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হামলার আগ মুহূর্তে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নি কলেজ থেকে বের হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজের সামনে তাকে মারধরের কোনো প্রস্তুতি দেখতে পাননি। সময়ক্ষেপণ করতে মিন্নি তাই রিফাত শরীফের বাধা উপেক্ষা করে আবার কলেজে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই নয়ন বন্ড বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য একত্রিত হয়ে রিফাত শরীফকে আটক করে মারধর করতে করতে কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রিফাতকে মারধর করা হচ্ছে দেখে স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিলেন মিন্নি। তবে পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে নয়ন বন্ড রিফাত শরীফকে মারধর শুরু করলে মিন্নি তখনই এগিয়ে আসেন।

এ দিকে মিন্নিকে আসামি করার পর মামলাটিও মোড় নেয় অন্যদিকে। এরপর নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে হাইকোর্ট থেকে বিচারিক কার্যক্রম যতদিন চলমান ততদিন পর্যন্ত মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় জামিন পান। বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে নিজের আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলামের জিম্মায় জামিনে ছিলেন মিন্নি।

উচ্চ আদালতে যাবেন মিন্নির বাবা

গতকাল রায় ঘোষণার পর মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তার মেয়েকে নির্দোষ দাবি করেন। এ সময় তিনি ন্যায়বিচার পেতে উচ্চ আদালতে যাবেন বলেও ঘোষণা দেন।

মিন্নির বাবা বলেন, প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে আমার মেয়েকে সাক্ষী থেকে আসামি করা হয়েছে। সারাদেশের মানুষ দেখেছে আমার মেয়ে মিন্নি কিভাবে তার স্বামী রিফাতকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই মিন্নিকে আসামি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই আমার বাসা থেকে আমাকেসহ আমার মেয়েকে পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে আসামি শনাক্ত ও জবানবন্দি নেওয়ার জন্য। কিন্তু সকাল পৌনে ১০টার দিকে এনে রাত ৯টায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর কোনো কারণ আমি আজও বুঝতে পারছি না।

Comment here