সালিসে ‘শরিয়তি কায়দায়’ মারধর, অপমানে কিশোরের আত্মহত্যা - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

সালিসে ‘শরিয়তি কায়দায়’ মারধর, অপমানে কিশোরের আত্মহত্যা

পঞ্চগড় প্রতিনিধি : পঞ্চগড় সদর উপজেলায় গ্রাম্য সালিসে শিশু ধর্ষণের অভিযোগ তুলে ইসলামী শরিয়তি পদ্ধতিতে খয়রুল ইসলাম (১৭) নামের এক দিনমজুর কিশোরকে মারধর করা হয়েছে। এ ঘটনায় সালিস শেষে বাড়ি ফিরে ওই কিশোর ক্ষোভ ও অপমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলায় অমরখানা ইউনিয়নের সোনারবান বাঁশবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আজ শুক্রবার দুপুরে পুলিশ ওই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছে।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে সোনারবান বাঁশবাড়ি মসজিদের সামনে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে খায়রুল ইসলাম নামের ওই দিনমজুরকে বাড়ি থেকে ধরে এনে সালিসে বসায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালীরা। সালিসে ওই শিশুর মা অভিযোগ করেন, গত ২০ এপ্রিল দুপুরে তার ছয় বছরের মেয়েকে স্থানীয় গড়ের নিচে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে খয়রুল। এ ঘটনায় সালিসের শুরুতেই তাকে এক দফা মারধর করা হয়।

ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করে খয়রুল সালিসে জানায় গড়ের নিচে সে ও তার মামাতো ভাই আজিত বসেছিল। শিশুটিও সেখানে বসেছিল। এ সময় ওই কিশোরের বাবা আবদুর রশিদ সালিসে উপস্থিত হলে সবাই তাকে গালিগালাজ করতে থাকেন। অপমান সইতে না পেরে ওই কিশোরের বাবা নিজেই তার ছেলেকে জুতাপেটা করেন। পরে তিনি সালিসে উপস্থিতি বিচারকদের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার অনুরোধ জানান।

কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে শরিয়তি বিচারে তাকে কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি একত্র করে মারধর শুরু করেন। সালিস পরিচালনা করেন অমরখানা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কদম আলী, ৩, ৫, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের স্বামী আক্কাস আলী, বাঁশবাড়ি মসজিদ কমিটির সভাপতি কিতাব আলী, সাধারণ সম্পাদক জাকের খাঁ, আবু খয়ের ও দেলোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তবে ঘটনার সময় খয়রুলের সঙ্গে তার মামাতো ভাই আজিত থাকলেও তার কোনো বিচার করা হয়নি। বিচার শেষে বাড়ি ফেরার সময় আজিতের বিচার না হওয়া নিয়ে তার চাচাতো ভাই দেলোয়ারের সঙ্গে তর্ক হয় খয়রুলের। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ি গিয়ে পরিবারের লোকজন দেখতে, পায় খয়রুল তার ঘরের আড়ার সঙ্গে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

খয়রুলের বাবা আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে সালিস বসিয়েছেন। আমি সালিসে গিয়ে তাদের কথা সইতে না পেরে নিজেই আমার ছেলেকে মারধর করি। পরে বিষয়টি তাদের তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমার কোনো কথা শোনেনি। তারা আমার ছেলেকে শরিয়তি পদ্ধতিতে অনেক মারধর করে। কোনো কিছু না করেও এমন অপমান সইতে না পেরে আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।’

খয়রুলের প্রতিবেশী আবদুল জলিল বলেন, ‘আমরা শুনেছি ঘটনার দিন খয়রুল তার মামাতো ভাই আজিতের সাথে বাড়ির পাশের গড়ের নিচে বসেছিল। ওই শিশুটিও তার সাথে বসেছিল। কিছুক্ষণ পরে স্থানীয় এক মেয়ে শিশুটিকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পরে হঠাৎ খয়রুলের বিরুদ্ধে তারা ধর্ষণের অভিযোগ তোলে। তাকে নিয়ে সালিস বসায় এবং শরিয়তি পদ্ধতিতে মারধর করে। সে যদি ধর্ষণ করেই থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা মামলা করুক। যদি প্রমাণিত হয় আদালত তাকে শাস্তি দেবে। কিন্তু তারা তা না করে নিজেরাই শাস্তি দিয়েছে। অথচ ঘটনায় সময় সেখানে আজিত থাকলেও তার কোনো বিচার করেনি তারা।’

ওই সালিসে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা কদম আলী বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগে সালিসে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা তার বাবাকে বলেছি, তার ছেলের বিচার যেন সে নিজেই করে। ওর বাবা জুতা দিয়ে কয়েকটা মাইর দিয়েছে। পরে আমি চলে যাই। এরপর কি হয়েছে তা আমি জানি না। আজিতের বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ তোলেনি তাই তার বিচার হয়নি।’

অমরখানা ইউনিয়নের ৩, ৫, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য শাহনাজ পারভীন বিউটি বলেন, ‘আমি ব্যস্ততায় ওই সালিসে যেতে না পারায় আমার স্বামী উপস্থিত ছিল। ওই ছেলেকে অন্য কেউ মারধর করেনি। তার বাবাই তাকে মারধর করেছে। তবে দেলোয়ার তাকে আত্মহত্যা করতে বলেছিল।’

পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু আককাছ আহমেদ বলেন, ‘ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলা হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

Comment here