স্বর্গ মেলে কালো টাকায় - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
আন্তর্জাতিক

স্বর্গ মেলে কালো টাকায়

কালোটাকার মালিকরা দেশে-বিদেশে বড় ধরনের সুবিধাই ভোগ করছেন। ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে শাস্তি দূরের কথা তাদের দেওয়া হচ্ছে নানা পুরস্কার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগদ অর্থ নিয়ে গেলে নাগরিকত্ব দেওয়াসহ আলিশান বাড়ির মালিক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশেও কালোটাকার মালিকদের জন্য শিল্পপতি ও ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে নতুন বাজেটে। এভাবে অবৈধপথে অর্থ উপার্জনের কারণে শাস্তি না হওয়ায় ঘুষ-দুর্নীতি বাড়ছে। এসব অর্থের একটি অংশ বিদেশে পাচারও হচ্ছে।

কাগজ-কলমে পৃথিবীর সব দেশেই কালোটাকা বা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সবাই-ই কালোটাকার মালিকদের যেন স্বর্গ তৈরি করে রেখেছে। অনুন্নত, উন্নয়নশীল, উন্নত সব দেশেই কালোটাকার মালিকরাই সর্বেসর্বা।

মুখে কালোটাকা নিয়ে দুয়েকটি কথা বলা গেলেও এর মালিকরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটেও কালোটাকার মালিকদের জন্য রাখা হয়েছে ফ্ল্যাট-বাড়ি ও সুরক্ষিত বিশেষ সুবিধাপ্রদত্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করে শিল্পপতি হওয়ার সুযোগ। কালোটাকার মালিকদের সুখবর দেওয়া হয়েছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ও জমি কেনা এবং ভবন নির্মাণে কালোটাকা বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

সংশোধিত বাজেটে জমি কেনার সুযোগ বাতিল করা হয়। সংসদে পাস হওয়া অর্থবিলের পর মূলত তিনভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে। দ্বিতীয়ত এলাকাভেদে নির্দিষ্ট অঙ্কের কর দিয়ে ফ্ল্যাট কিনলে। তৃতীয়ত অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক বিনিয়োগের মাধ্যমে।

দেশের শিল্পায়ন বৃদ্ধির জন্য সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে বিনিয়োগকারীদের স্বল্পমূল্যে জমি, করছাড় সুবিধা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে। সেই বিশেষ সুবিধাসংবলিত এলাকাগুলোয় কালোটাকার মালিকদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

এখানে অর্থ বিনিয়োগ করলে সেই অর্থ কোথা আসছে তা জানতে চাইবে না সরকার। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো কালোটাকার মালিকদের সুবিধার হাতিয়ারে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। দেশে ঘুষ-দুর্নীতির কারবার বেশি হয় সরকারি বিভিন্ন সংস্থায়। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে তারা গড়ে তোলেন বাড়ি-গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

সম্প্রতি পুলিশের ডিআইজি মিজান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছির, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল দম্পতি, টাকার বিনিময়ে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ৭ খুনের ঘটনা সরকারি কর্মকর্তার অন্যতম দুর্নীতির উদাহরণ। আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তাদের গাড়ি, বাড়ির জন্য স্বল্পসুদে ঋণ, সন্তানদের শিক্ষাভাতা, নববর্ষের উৎসবভাতাসহ আনুষঙ্গিক নানা সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। এর পরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কমেনি বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগের পাশাপাশি অনেকে বিদেশে পাচার করছেন। ফলে প্রতিবছর অর্থপাচার বেড়েই চলেছে। দেশের অনেক রাজনীতিবিদ ও ছোট-বড় সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সন্তানদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করছেন। সেখানে নিজেদের বাড়ি ও গাড়ি ব্যবহার করছেন। পড়াশোনার খরচসহ তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাঠাচ্ছেন তাদের পিতামাতা।

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয় মূলত চারভাবে। দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ডলার কিনে সরাসরি বিদেশে পাচার করা হয়। আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এ ছাড়া রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) ও হুন্ডি। অর্থপাচারের সর্বশেষ তথ্য পাওয়া গেছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) এক বার্ষিক প্রতিবেদনে। সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকের সংখ্যা ২৪৮টি।

সেখানে অ্যাকাউন্টধারীদের তথ্য অতি গোপনভাবে সংরক্ষণ করা হয়। আইন করে অ্যাকাউন্টধারীদের যে কোনো তথ্য প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এ জন্য বিশ্বের কালোটাকার মালিকরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় অর্থ জমা রাখে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ; দেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা (প্রতি ফ্রাঁ ৮৬ দশমিক ৪১ টাকা ধরে)।

এক বছর আগে এ অঙ্ক ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত ১০ বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই বছর ছাড়া প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ বেড়েছে। শুধু ২০১১ ও ২০১৭ সালে জমার পরিমাণ কমে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অর্থপাচারের বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশ অর্থপাচারের প্রধানত দুটি কারণ। এখানে অর্থ রাখা নিরাপদ মনে করেন না। দ্বিতীয় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। এখানে ব্যবসা শুরু করা এবং টিকে থাকা বিভিন্ন কারণে অনেক চ্যালেঞ্জিং। মূলত এই দুটি কারণেই অর্থপাচার হচ্ছে। অর্থপাচারে প্রধান কারণ হচ্ছেÑ কাউকে শাস্তি না দেওয়া।

প্রভাবশালীরা বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিজেদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ নিরাপদ রাখতে বিদেশে পাচার করেন। দেশের ভেতরে অস্থিতিশীলতার কারণে নির্বাচনকালীন টাকা পাচার বাড়ে। আর পাচার বন্ধের ব্যাপারে সরকারের কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে এমন কিছু চোখে পড়ে না। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে পাচারকারীদের নাম এলেও তদন্তেই আটকে আছে তাদের বিচার।

বিচারহীনতার কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্নভাবে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ৫৯০ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। মালয়েশিয়ার সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বাংলাদেশিদের পাচারের তথ্য জানা যায়। অন্য দেশের অর্থপাচারকারীদের জন্য নাগরিকত্ব দিয়ে বিলাসবহুল ভবন ও শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে। বিদেশির জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

পাচারকারীদের জন্য অভয়ারণ্য রয়েছে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। কানাডায় রয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত একটি অঞ্চল ‘বেগমপাড়া’। অবৈধ অর্থপাচার করে এই পাড়ায় বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হয়েছেন বাংলাদেশিরা। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নাগরিকত্ব দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আকর্ষণীয় সুযোগ দিচ্ছে। তুলনামূলক কম কর দিয়ে ওই সব দেশেও বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছেন।

Comment here