৪০ বছরের পুরনো জনবল কাঠামোয় চলছে প্রশাসন - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

৪০ বছরের পুরনো জনবল কাঠামোয় চলছে প্রশাসন

১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে প্রণীত এনাম কমিটির সুপারিশ ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী চলছে প্রায় সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর। ৪০ বছরে কোনো ক্যাডারের পদ হালনাগাদ করা হয়নি। তবুও কয়েক হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে। এ নিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য প্রকট। সরকারি দপ্তরগুলোয় সেবার আরও উন্নত প্রশাসনের শৃঙ্খলার লক্ষ্যে পুরনো ওই জনবল কাঠামোয় সংস্কার আনার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়ম না মেনে কয়েক হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে। সিনিয়র সচিব, সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১, অতিরিক্ত আইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও সৃষ্টি করা হয়। আর বাণিজ্য, জনস্বাস্থ্যের মতো ক্যাডারগুলোয় পদ সৃষ্টির অনুমোদন জটিলতার কারণে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

পদোন্নতি-পদায়নে পিছিয়ে থাকা একাধিক ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, পদ না থাকলেও ‘সুপারনিউমারারি’ (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) পদ সৃষ্টি করে প্রতি বছর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। অন্য ক্যাডারে এভাবে পদোন্নতির সুযোগ নেই। ফলে তাদের মধ্যে এই নিয়ে সমালোচনা আছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, জনপ্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৭৯ জন। প্রশাসনে এখন বিভিন্ন পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব রয়েছেন অন্তত ১৬ জন। নির্বাচনের বছরে এসে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে।

পদোন্নতি বঞ্চিতরা জানান, তাদের উপরের পদে কাউকে চুক্তিতে নিয়োগের ফলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। উপরের পদে নিয়োগের ফলে নিচে পদোন্নতির ব্লক তৈরি হয়। এ নিয়ে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে তৈরি হয় অসন্তোষ।

সময়ের প্রয়োজনে জনবল কাঠামো হালনাগাদ না হওয়ায় দপ্তরগুলোয় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেলেও পদ না থাকায় তাদের বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের দপ্তরে নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে।

একটি মন্ত্রণালয়ের জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ দুটি, কর্মরত আছেন ১৩ জন। যুগ্ম সচিবের ছয় অনুমোদিত পদের বিপরীতে কাজ করছেন ২৭ জন। উপসচিবের ২৬টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে আছেন ৩৭ জন। অনেক মন্ত্রণালয়ের জনবল কাঠামোতেও এ ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমের সভাপতিত্বে ২০২১ সালে দুই দিনব্যাপী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর আর দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। গত ২১ ডিসেম্বর জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করতে বৈঠক করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘পুরনো জনবল কাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা নতুন পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে পদ সংখ্যা বাড়ানো হবে। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। জনবল কাঠামো হালনাগাদ হলে পদের বেশি পদোন্নতির দুর্নাম আর থাকবে না। চাহিদা অনুযায়ী স্থায়ী পদ সৃজন হলে পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতিও দেওয়া হবে না।’

পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন সরকারের প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ৭০০টি, সব প্রকল্পে একজন করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প তৈরি হলেও সে জন্য আলাদা অর্গানোগ্রাম তৈরি করা যায় না। অনেক মন্ত্রণালয় সেখানে নিজেদের কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় সেখানেও জনপ্রশাসন থেকে কর্মকর্তা দিতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের ১৩০টি পদের বিপরীতে ৩৯৮ জন এবং যুগ্মসচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে ৮৭৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। একইভাবে উপসচিবের এক হাজার ছয়টি পদের বিপরীতে রয়েছেন এক হাজার ৭০৯ জন কর্মকর্তা। প্রশাসন ও পুলিশের মতো অন্যান্য ক্যাডারে তা হচ্ছে না। তারা ‘উচ্চপদস্থ’ শূন্য পদ না থাকায় পদোন্নতি পাচ্ছেন না। জনবল কাঠামো হালনাগাদ না হওয়ায় সেখানে নতুন পদও সৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু গত ৪০ বছরে আগের চেয়ে অন্যান্য ক্যাডারের কাজ বেড়েছে কয়েক গুণ।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ১৯৮৩ সালে এনাম কমিটি যখন জনবল কাঠামো তৈরি করে, তখন বেশির ভাগ কলেজে অনার্স-মাস্টার্স ছিল না। বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোয় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী আছেন। অথচ শিক্ষকের পদ আছে মাত্র ১৬ হাজার ৩৮টি। আবার হাজার হাজার কর্মকর্তা থাকলেও একজন কর্মকর্তারও গ্রেড-১ নেই। তিনি বলেন, পদ সৃজনের দায়িত্ব

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। তারা অন্যান্য ক্যাডারের পদ সৃজন করছে না। কিন্তু নিজেরা সুপারনিউমারারির নামে পদোন্নতি নিচ্ছেন।

অন্য ক্যাডার (বিসিএস কৃষি, খাদ্য, তথ্য, কর, গণপূর্ত ও স্বাস্থ্য) কর্মকর্তাদেরও অভিযোগ, আগের তুলনায় তাদের কাজের পরিধি বেড়েছে অনেক। কিন্তু নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এতে সরকারি কিছু অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিন-রাত কাজ করছেন, আবার অনেকের পদ থাকলেও কাজের তেমন সুযোগ নেই। কর্মকর্তারা বলেন, যেসব দপ্তরের ক্ষমতা বেশি, তারা ইচ্ছামতো নতুন পদ সৃষ্টি করে নিয়েছে।

Comment here