নিজস্ব প্রতিবেদক : দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের রিমান্ড নামঞ্জুর করেছেন আদালত। তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার তার জামিন আবেদনের শুনানি হতে পারে। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর রোজিনা ইসলামকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেওয়া হলে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বিচারক।
একদিকে আদালতে যখন রোজিনার আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠাচ্ছেন, অন্যদিকে এই সাংবাদিককে হেনস্তা, গ্রেপ্তার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে যতটুক নিউজ থাকে, দেওয়ার মতো। আমরা তো সেটা আপনাদেরকে দিয়ে আসছি। তো ওই নিউজের পরে আমি ওখান থেকে বাসায় চলে আসি। বাসায় আসার ঘণ্টা দুয়েক পরে আমার কাছে খবর আসলো যে একটা ইনসিডেন্ট ওখানে হয়েছে। আমি যতটুকু শুনেছি সেটাই বলি, ওখানে সচিব সাহেবের পাশে যে রুম আছে সে রুমে ফাইল রাখা আছে। সচিব বা তার পিএসরা মিটিংয়ে ছিল রুমে ছিলেন না, রুম খালি ছিল। সেখানে কোনো এক সাংবাদিক ওই রুমে ঢুকে ওই ফাইলের ছবিগুলো তুলছিলেন। এবং কিছু ফাইল উনি নিজে নিয়েছিলেন। এর মধ্যে খালি রুম ছিল তখন ওখানকার যারা ডিউটিতে ছিল, তারা এসে দেখলো এক ব্যক্তি ওখানকার ফাইলের ছবি তুলছে, ফাইল কিছু নামিয়ে ব্যাগে ও পকেটেও নিয়েছে। তো আমাদের মহিলারা খবর পেয়ে এসে তাকে ধরেছে যে, আপনি কেন এটা করলেন, তো তখন তার কাছ থেকে কাগজ এবং ফাইলগুলো নিয়েছে। এরমধ্যে পুলিশকে খবর দিছে যতদূর আমি জেনেছি।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘পুলিশের এসপি আসছে, অন্যরা আসছে, তখন তারা এটা টেকওভার করছে। তখন ওনারা মোবাইলটাও নিয়েছে, মোবাইলেও অনেক ছবি পেয়েছে। এখন এই জিনিসটাও দুঃখজনক। কারণ, এ ফাইলগুলো ছিল টিকা সংক্রান্ত, আমরা যে রাশিয়ার সাথে টিকা চুক্তি করছি, চায়নার সাথে করছি এবং সেগুলা নন ডিসক্লোজার আইটেম। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বলেছি যে, আমরা এটা গোপনে রাখবো; বলবো না। তো সেগুলো যদি বাইরে চলে যায় তো আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলাম। আমরা টিকা নাও পেতে পারি, তারা আমাদের টিকা নাও দিতে পারে। কাজে এটা দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এটা একটা সিক্রেট ডকুমেন্ট, সেটা বাইরে যাওয়া উচিত হয়নি। আপনারা চাইলে তো আমরা সবই বলি।’
রোজিনাকে আটকে রাখার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের সাথে যারা আসছে ওনারা তার সাথে… সে তো শুয়ে পড়ছে আমরা যেটা দেখছিলাম। শুনেছিলাম শুয়ে পড়ায় তাকে নিতে পারছিল না, বের করতে পারছিল না। এটাতেই অনেকক্ষণ সময় গেছে এটাই আমাকে বলা হয়েছে। এবং কোনো শারীরিক আঘাত বা নির্যাতন কিন্তু হয়নি, এ কথাটা সঠিক না। একজন সিনিয়র অফিসার সে, এডিশনাল সেক্রেটারি এরাই ওনার সাথে পার্সোনালি ডিল করেছে। পরে সিক্রেট বিষয় আসায় পুলিশ আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো আপনাদের সাথে যেখানে চেয়েছেন কথা বলেছি। আমার পক্ষে যা সম্ভব তাই তো বলি। রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ এর ভেতর থেকে সবই বলি। আর আমি তো সেখানে ছিলাম না, বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। এখন আইনের যে বিষয়টা, তাকে যদি দুর্নীতির রিপোর্ট করেছেন সেটা নিয়ে তো আজকের এটা না। আজকের বিষয়টা তো ওখানে, যেটা ঘটেছে সেটা নিয়ে কথা বলতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কক্ষ থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি চুরির চেষ্টা এবং মোবাইলে ছবি তোলার’ অভিযোগ দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় যে মামলা করা হয়েছে, যেখানে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় চুরি এবং ১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন সোমবার বিকেল ২ টা ৫৫ মিনিটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তরে রোজিনা ইসলাম নামীয় একজন নারী প্রবেশ করেন। এ সময় একান্ত সচিব দাপ্তরিক কাজে সচিবের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। উক্ত নারী দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্র শরীরের বিভিন্ন স্থানে লুকোনো এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলেন। এ সময় সচিবের দপ্তরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মো. মিজানুর রহমান খান দেখতে পান এবং তাকে বাধা প্রদান করেন এবং তিনি নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে কক্ষে কি করছেন মর্মে জানতে চান।
এ সময় তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় প্রদান করেন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম, উপসচিব জাকিয়া পারভীন, সিনিয়র সহকারী সচিব শারমীন সুলতানা, সচিবের একান্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞা, সিনিয়র সহকারী সচিব মোসাদ্দেক মেহদী ইমাম, অফিস সহায়ক মো. মাহফুজুল ইসলাম, সোহরাব হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও স্টাফগণ ঘটনাস্থলে আসেন এবং অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগম তল্লাশি করে তার কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এবং ডকুমেন্টসের ছবি সম্বলিত মোবাইল উদ্ধার করেন।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, ডকুমেন্টসগুলো তিনি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে শাহবাগ থানার মহিলা পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে তাকে জিম্মায় নেন। এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয়/সংগ্রহ সংক্রান্ত নেগোসিয়েশন চলমান রয়েছে এবং খসড়া সমঝোতা স্মারক ও নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে। সমঝোতা স্মারক নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মাঝে প্রতিনিয়ত পত্র এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। উক্ত নারী যেসকল নথিপত্রের ছবি তুলছিলেন তার মধ্যে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও ছিল। এসকল তথ্য জনসমক্ষে প্রচার হলে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার অশঙ্কা রয়েছে। উল্লিখিত কাগজপত্রসমূহ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত আছে, যা পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রদর্শন করা হবে।
রোজিনা ইসলাম ওই অফিস থেকে কোনো নথি সরানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আর প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তার এই সহকর্মী ‘আক্রোশের শিকার’ হয়েছেন বলে তাদের সন্দেহ।
Comment here