ইউসুফ সোহেল : অবৈধ বিদেশি সিগারেটে সয়লাব সারাদেশ। দেশের নৌ, স্থল ও আকাশ- এ তিনপথেই অন্য পণ্যের আড়ালে অবাধে আসছে বিদেশি সিগারেট। নিম্মমানের এসব সিগারেট পাইকারি বাজারে বিক্রির পাশাপাশি ফেসবুকে পেজ খুলেও বিক্রি করছে একাধিক চক্র। এতে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, ধূমপায়ীরা পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, সবচেয়ে কমদামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল, মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ; কিন্তু গত তিন বছরে সেই চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে।
কাস্টম হাউসের তথ্যমতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গত চার বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বৈধভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইজি ও মন্ড, পাইন ব্র্যান্ডের এক শলাকা সিগারেটও আমদানি হয়নি। অথচ সারাদেশের খুচরা বাজারে এসব ব্র্যান্ডে ছেয়ে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাস্টমস গোয়েন্দা চট্টগ্রাম অঞ্চলই জব্দ করেছে প্রায় ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১৩শ বাইশ মিনি কার্টন বিদেশি সিগারেট।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো পরীক্ষা ছাড়াই অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সিগারেট। এসব সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হতে পারে। নিম্নমানের সিগারেট জৈবিক বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে, এমনকি নিম্নস্তরের এক্সপোজারেও এর শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যায়নরত তরুণ
রহিম আহমেদ (২১) বিদেশ থেকে আসা নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট খাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই সিগারেটে পাওয়া এক ধরনের টক্সিনের কারণে রহিমের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম গতকাল বৃহস্পতিবার আমাদের সময়কে জানান, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি সিগারেট বাংলাদেশে নিয়ে আসছে বেশ কিছু চক্র। এই চক্র বেশি সক্রিয় চীনে। ওই দেশ থেকে বৈধ পথে অবৈধ পন্থায় বেশি সিগারেট দেশে ঢুকছে। অধিকাংশ চক্রকে আমরা চিহ্নিত করেছি। চক্রের বেশ কিছু সদস্য গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি মেঠোপথ ও উখিয়ার নাফনদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে চীনের তৈরি বিবিধ নমুনার সিগারেটের চালান। এসবের মধ্যে রয়েছে- ওরিসন, লাইট, ইএসএস লাইট, প্রাইড, মন্ডসহ চিকন শলার অনেক সিগারেট। গেল আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে তেরশ চৌদ্দ কার্টন চীনা সিগারেট জব্দ করে এবিপিএন। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪৪৬ কার্টন সিগারেটসহ আটক করে র্যাব। এ ছাড়াও নাইক্ষ্যংছড়ি থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে অবৈধ সিগারেটের চালান আটক করে। ঘুমধুম কচুবনিয়া ব্রিজ এলাকায় ১৫০০ প্যাকেট বিদেশি সিগারেট জব্দ করা হয় একই মাসে। সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর সাগরে থাকা বিদেশি জাহাজ থেকে অবৈধভাবে সিগারেটসহ মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের সময় একটি স্পিডবোট তল্লাশি করে ১৩টি ১০০ ইউএস ডলার, ১টি ৫০ ডলার, ৫ কার্টন ১ হাজার শলাকা সিগারেট, ১৬টি জারিজেনে থাকা ৬৪০ লিটার ডিজেল জব্দ করে কোস্টগার্ড।
সূত্রমতে, এভাবেই সাগরে ডলারের বিনিময়ে বিদেশি জাহাজ থেকে সিগারেট কিনে দেশের বাজারে বাজারজাত করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশি সিগারেট দেশে আনছে চোরাকারবারিরা। সেপ্টেম্বর মাসে চীন থেকে টেক্সটাইল পণ্য ঘোষণা দিয়ে বিদেশি সিগারেট খালাসের সময় ১৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় শুল্ক গোয়েন্দারা। টেক্সটাইল পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে এক কনটেইনার বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট। চট্টগ্রাম বন্দরের ৮ নম্বর ইয়ার্ডে অবৈধ সিগারেটের চালানটি আটক করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা। চালানটিতে সাত কোটি ১৩ লাখ টাকার শুল্কফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে বলে দাবি কাস্টমসের। গত ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পার্কি বিচের একটি পরিত্যক্ত বোটে অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদের সঙ্গে ১৩ কার্টন বিদেশি সিগারেট জব্দ করা হয়। সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের জাহাজ থেকে অবৈধ সিগারেট নামিয়ে দেশের বাজারে বাজারজাত করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। টেকনাফ, কুমিল্লা, মিরসরাইয়ের সীমান্তপথে দেশে ডোকানো হচ্ছে অবৈধ, নিম্নমানের সিগারেট। সম্প্রতি ঘুমধুম তদন্তকেন্দ্রের একদল পুলিশ সন্ধ্যায় ঘুমধুম ইউনিয়নের শীলপাড়া বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন বাবুল বড়ুয়ার দোকানের সামনে থেকে ১৫০ কার্টন নিম্নমানের বার্মিজ সিগারেটসহ দুজনকে আটক করে পুলিশ।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা অন্তত তিনটি বড় চালান জব্দ করা হয়েছে। গত জুলাই মাসে শাহ আমানত বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে দুবাই থেকে আনা ৭ হাজার ২৬২ কার্টনে সুপার স্লিম ইজি স্পেশাল গোল্ড, ইজি স্পেশাল লাইট, মন্ড স্ট্রবেরি ফ্লেভার, বেনসন লাইট ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট জব্দ করা হয়। সিগারেটগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ টাকা।
জানা গেছে, জার্মানির সিগারেট ওরিস চীনে তৈরি করে আনা হচ্ছে বাংলাদেশে। নিম্নমানের ওরিস সিগারেট ৯০ টাকা থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন এলাকায়। ঘুমদুম বর্ডার এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব সিগারেটের মূল বাজার ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপ। কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, ঘুমদুম ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে আনা এসব চীনা সিগারেট ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলে। অরিস সিলভার, অরিস প্লাস, মন্ড স্ট্রোভেরি নামের বিভিন্ন সিগারেট পাইকারি বিক্রির অভিনব বিপণন কৌশল অবলম্বন করছে চক্রের সদস্যরা।
কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি সিগারেট দুইভাবে আমদানি করার সুযোগ আছে; সাধারণ আমদানি ও বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে। সাধারণ আমদানির মাধ্যমে সিগারেট আনতে হলে উচ্চ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধায় নির্দিষ্ট পরিমাণে বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে আমদানি করা যায়। বৈধভাবে সিগারেট আমদানিতে ৬০২ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়; কিন্তু এই শুল্ক-কর পরিশোধ করে বন্দর দিয়ে সিগারেট আমদানির নজির নেই। তবে বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধায় সামান্য পরিমাণে সিগারেট আমদানি করছে। বিমানবন্দরে আসা যাত্রীদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর কারণে স্থলবন্দর ও নৌবন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে সিগারেটের চালান খালাস করার প্রবণতা বেড়েছে। তবে সবক্ষেত্রেই কাস্টমসের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
Comment here