ফয়সাল আহমেদ,গাজীপুর সদর প্রতিনিধি : শিল্প কারখানায় সরকারি শর্ত উপেক্ষা করা, জেলায় লকডাউন না থাকা, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে অসচেতনতা, সীমিত পরীক্ষা ও রিপোর্ট প্রদানে কালবিলম্ব, প্রশাসনের নজরদারী ও ব্যবস্থাপনার অভাবে গাজীপুরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন মাত্রা পেয়েছে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করা গাজীপুরে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় কোটি মানুষের বসবাস গাজীপুরে মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে ৮মার্চ। এরপর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরে কোয়ারেন্টিনে থাকা ইতালিফেরত এক ব্যক্তির দেহে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায় গত ১৬ মার্চ। যদিও গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ছোঁয়া অ্যাগ্রো নামে একটি পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ১০ এপ্রিল। শ্রমিকদের বাড়ি কাপাসিয়া ও শ্রীপুরে থাকায় ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পরে দুই উপজেলায়।
এদিকে নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের সীমান্ত হওয়ায় কালিগঞ্জেও বাড়তে থাকে করোনা রোগী। তবে সব ছাপিয়ে পোশাক কারখানায় সমৃদ্ধ গাজীপুর সদর শীর্ষস্থানে চলে আসে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার সকল শিল্পকারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। গত ১১ এপ্রিল থেকে গাজীপুর জেলাকেও অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময় অনেকটা ধাতস্থ হয় করোনা সংক্রমণ। এ অবস্থায় গত ২৭ এপ্রিল ও ২ মে জেলার সব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে কয়েকবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিকরা আসা যাওয়া করায় ফের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে গাজীপুর। এর পর থেকেই অনেকটা লাফিয়ে বাড়তে থাকে করোনার সংক্রমণ। বর্তমানে দিন দিন ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে গাজীপুরের পরিস্থিতি। ঈদুল ফিতরের পর সংক্রমিতদের অধিকাংশই পোশাক কারখানার শ্রমিক।
আজ বুধবার পর্যন্ত জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৩০ জন, মারা গেছেন ৬ জন। শুরু হতে এ পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার। একের পর এক পোশাক শ্রমিক আক্রান্ত হওয়ার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ যেমন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তেমনি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ সংক্রমণ রোধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ভাষ্য মতে, অধিকাংশ পোশাক কারখানার শ্রমিক নিম্নআয়ের শ্রমজীবী। তাদের মধ্যেই অনেকেই অসচেতন। জীবিকার তাগিদে তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাজীপুরের শিল্প কারখানায় কাজ করেন। তাদের অধিকাংশই ভাড়া বাড়ীতে গাদাগাদি করে বসবাস করেন। কর্মক্ষেত্রসহ কোথাও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার উপায় নেই।
পরিবার থেকে দূরে থাকায় করোনা আক্রান্ত হলে ব্যবস্থাপনার কথা ভেবে উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই অনেকেই কারখানার কাজ বন্ধ রেখে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অনেক কারখানায় শ্রমিক আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো খবর বা সংক্রমণ রোধে কারখানা কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিকের মধ্যে আতঙ্কও বিরাজ করছে। অনেক শ্রমিক জানিয়েছেন সরকারি শর্ত ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে কারখানা খোলার কথা থাকলেও কিছু দিন অনেকেই সতর্ক ছিল, পরে আর স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
শ্রীপুরের ধুনয়া এলাকার ডিবিএল গ্রুপের জিন্নাত নিটওয়্যার ইউনিট ২’র গার্মেন্টস কারখানার সুইং অপারেটর রওশন আরা। কর্মক্ষেত্রেই সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নমুনা দিলে গত শুক্রবার তার পজেটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর থেকে স্থানীয়দের উদ্যোগে বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন। বিষয়টি তিনি সঙ্গেড় সঙ্গেই কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানান। তবে বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ তার কোনো খোঁজ নেয়নি। এমনকি রওশনের সহকর্মীদের করোনা পরীক্ষাও করায়নি। এদিকে শ্রীপুর পৌর এলাকার ফখরউদ্দিন ও আমানটেক্স, মাওনা ফ্যাশন, কারখানার বেশ কয়েকজন শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বেশ কয়েকজন পোশাক কারখানা শ্রমিক করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেও প্রশাসন বা কারখানার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা করোনার উপসর্গ নিয়ে নমুনা দিতে গিয়েও স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভোগান্তিতে পড়েছেন। পরীক্ষার সুযোগ সীমিত হওয়ায় অধিকাংশই নমুনা দিতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কারখানা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় জেলা জুড়েই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেকটা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে জেলা জুড়েই। এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ফের করোনার হটস্পট হয়ে উঠবে গাজীপুর।
শ্রমিক ও স্থানীয়দের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গাজীপুরের সিভিল সার্জন খায়রুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজীপুরে শিল্প কারখানার শ্রমিকরা আক্রান্ত হওয়ায় জেলা জুড়েই অনেকটা ঝুঁকি তৈরি করছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের নজরদারী করা যাচ্ছে না।’
সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় কোটি মানুষের বসবাস গাজীপুর থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ ৩০০’র অধিক নমুনা সংগ্রহ করতে পারছেন। বেশি করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে সুযোগ সীমিত। এছাড়া নমুনা দিলে রিপোর্ট আসতেও কিছু সময় লাগে। তাই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকরা যদি আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা থেকেই যাচ্ছে।’ এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে জেলার সবকিছুই সচল করা হয়েছে। এখন শুধু এক জেলা থেকে অন্য জেলার বাসিন্দাদের আগমন ও প্রস্থানে নজরদারী করা হচ্ছে। শ্রমিকদের নিরাপদ রাখতে পোশাক কারখানা মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া শিল্পকারখানাগুলোতে নজরদারী করার জন্য ইতিমধ্যেই কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা কাজ শুরু করছে।’
 
            


 
                                 
                                
Comment here