নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০১৪ সালে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলন হয় নরসিংদীতে। তখন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগ পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করতে পারেনি স্থানীয় নেতাদের তোপের মুখে। সম্মেলনের অন্তত ১৫ দিন পর যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পাপিয়াকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসানো হয়। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর পাপিয়ার একের পর এক কুকীর্তি যখন বেরিয়ে আসছে; ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনে তার এত বড় পদ প্রাপ্তি নিয়েও যখন চলছে বিস্তর সমালোচনা, তখন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে তার এ পদ বাগিয়ে নেওয়ার তথ্য।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যুব মহিলা লীগের জেলা সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেওয়ার পর ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন পাপিয়া। অভিজাত হোটেলে যৌন-কারবারসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
জেলা নেতাদের প্রবল আপত্তির মুখেও পাপিয়াকে কেন্দ্র থেকে এত বড় পদে অধিষ্ঠিত করা প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হীরু (বীরপ্রতীক) আমাদের সময়কে বলেন, জেলা যুব মহিলা লীগের কাউন্সিলের সময় আমি মঞ্চে বসে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আক্তারকে অনুরোধ করেছিলাম, পাপিয়াকে যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না আনা হয়। তিনি ছাড়াও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে তখন একমত হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল একমত না হওয়ায় তার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। পরে আমি নরসিংদীর কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণা করতে দেইনি। সম্মেলনের কিছুদিন পর ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেটা কী কারণে করা হয়েছিলÑ তা আজও আমি জানি না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল আমাদের সময়কে বলেন, কমিটি হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া পাপিয়ার পক্ষে সুপারিশ করেন। এ ছাড়া নরসিংদী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী রাজি উদ্দিন রাজু পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই তাকে পদ দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাপিয়ার স্বামী নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু ২০০০ সালের দিকে। চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও বিভিন্নভাবে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা কামানোই ছিল সুমনের প্রধান পেশা। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর তিনি আলোচনায় আসেন। এরই মধ্যে পাপিয়াকে বিয়ে করেন সুমন। বছর তিনেক পর পাপিয়ার ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই সময় পাপিয়াকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এ কারণে তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। এর পর পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন ঢাকার সাবেক এক এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা আছে।
নরসিংদী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী পাপিয়া ও তার স্বামীর অনুসারী। তারা ‘কিউ অ্যান্ড সি’ ট্যাটু ব্যবহার করেন। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে। জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ বাগানোর পর বেপরোয়া হয়ে ওঠা পাপিয়া রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে অস্ত্র, মাদক কারবার ছাড়াও নানা অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। স্পর্শকাতর ও সম্মান হানিকর ভিডিও ধারণ করে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াও ছিল পাপিয়ার অবৈধ টাকার অন্যতম উৎস।
এদিকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি তৌহিদা সরকার রুনা বলেন, পাপিয়ার এসব অপকর্মের তথ্য পেয়ে আমরা হতবাক হয়ে গেছি। তিনি দলের পদ নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। মাঝে মধ্যে নরসিংদী আসতেন আবার চলে যেতেন। তিনি বলেন, তার অপকর্মের দায় দল নেবে না। ২০১৪ সালে দলের সম্মেলনের সময় পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ না দিতে মঞ্চে বসে প্রতিবাদ করেছিলেন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। তখন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিমানবন্দর থেকে আটকের সময় র্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন পাপিয়া। বলেছিলেন, তাদের দেখে নেবেন। গর্জন করে উঠেছিলেন এই বলে যে, ‘তোরা কি জানিস, আমি কে?’
এদিকে পাপিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া তিনটি মামলার তদন্ত করতে চায় র্যাব। ইতোমধ্যে তদন্তের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে র্যাব। খুব শিগগিরই মামলার তদন্তভার র্যাব পাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
পাপিয়ার সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠতার অনেক সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, এসব তথ্যের যাচাই-বাছাই চলছে। যারা তার অপরাধকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বা তাকে এসব কাজে সাহায্য করেছেন, তাদেরও ধরার জন্য অভিযান চালানো হবে। এক্ষেত্রে পাপিয়ার সেলফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখছে র্যাব।
পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রত্যেকের ১৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে চমকে যাওয়ার মতো একের পর এক তথ্য দেওয়া শুরু করেছেন পাপিয়া।
নরসিংদী জেলা শহরে বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় একটি পাকা ও আরেকটি সেমিপাকা টিনশেড বাড়ি আছে পাপিয়ার। সেমিপাকা টিনশেড বাড়িটি তিনি এবং তার অনুসারীরা বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একই এলাকার বেলদী মোড়ে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ ছাড়াও ৬ শতাংশের একটি প্লট রয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে স্বামী সুমনের দোতলা একটি বাড়ি আছে। এ ছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়াহ ও একটি ভেজেল ব্র্যান্ডের কার আছে। নরসিংদী শহরে তার অনুসারীদের ব্যবহারের জন্য ৫টি মোটরসাইকেল রয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে সুমনের নামে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদেশে নারী পাচার ও বিদেশ থেকে নারীদের এনে তাদের দিয়ে অবৈধ কাজের জন্য ‘বিডি স্কট সার্ভিস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠান করেন পাপিয়া। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সুন্দরী নারীদের এনে দেশের প্রভাবশালীদের সরবরাহ করতেন পাপিয়া। ওইসব রাঘববোয়ালদের হাত ধরেই বেপরোয়া হয়েছেন পাপিয়া। পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। ওই মোবাইল ফোনগুলোর কললিস্টের সূত্র ধরে বেশ কিছু প্রভাবশালীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা থেকে বড় ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে।
ইতোমধ্যে রাজধানীর বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর থানায় তিন মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনসহ চারজনকে ১৫ দিনের রিমা-ে নিয়েছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাপিয়া রাজনীতির আড়ালে মাদক ও নারী বাণিজ্য করে আসছিলেন। তার উদ্ধার হওয়া ফোনগুলোতে ভিআইপিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। এ মোবাইল নাম্বার থেকে পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রভাবশালীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
সূত্র জানায়, মদের পার্টির আয়োজনের আড়ালে থাকত অপরাধ পরিকল্পনার মিশন। তার আগে পার্টিতে মদ পান করিয়ে মাতাল করা হতো তার সঙ্গে থাকা তরুণীদের। কোনো মেয়ে চলে যেতে চাইলে তার গোপন ভিডিও দেখিয়ে বাধা দিতেন পাপিয়া। পাপিয়ার কাছ থেকে গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত অনেক ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করা হয়েছে। এতে অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্র্তের দৃশ্য রয়েছে। ওই ভিডিওগুলো পুলিশের অপরাধ বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল আমাদের সময়কে বলেন, মামলার তদন্তের জন্য আমরা আবেদন করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা পেয়ে যাব।
জানা গেছে, নিজের কেএমসি কারওয়াশ নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসার আড়ালে মাদক কারবারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন পাপিয়া। দরিদ্রতার সুযোগে গ্রামের সহজ-সরল মেয়েদের নিজ দলে ভেড়াতেন। নানা সুযোগ সুবিধার কথা বলে অপকর্মের প্রস্তাব দিতেন পাপিয়া ও তার স্বামী মতি সুমন। তবে গত পাঁচ বছরের কীভাবে এত টাকার মালিক বনে গেলেন এ দম্পতি, এ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। জানা গেছে, বিদেশে পাপিয়ার বারের ব্যবসা রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারওয়াশ সেন্টারে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আনাগোনা ছিল। এ ব্যাপারে কখনো কেউ প্রশ্ন করার সাহস পায়নি।
নরসিংদী শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামীর চালচলন দেখে প্রথম থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আয়ের উৎস সর্ম্পকেও ধোঁয়াশা ছিল আমাদের মনে।
Comment here