বোরকার আড়ালে ছিল ছদ্মবেশী পুরুষ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

বোরকার আড়ালে ছিল ছদ্মবেশী পুরুষ

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামি নুরুদ্দিন (৩০) ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল সকালে ও বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা এবং ঢাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে এজাহারভুক্ত বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারের পর কিছু কিছু তথ্য বেরিয়ে আসছে। এতে একটি বিষয় পুলিশ বুঝতে পারছে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঠা-া মাথায় এই অপরাধ সংঘটন করা হয়। বোরকাপরা যে চারজন নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, তাদের মধ্যে ছদ্মবেশী পুরুষ ছিল বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য পাচ্ছেন পুলিশের তদন্তকারীরা।

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় কাউন্সিলর মাকসুদুল আলমকে ঢাকা এবং তার এক সহযোগীকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পিবিআই ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত দুজনকে ফেনীতে আনা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য গণমাধ্যমকে পরে জানানো হবে।’ গতকাল বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ির সিডস্টোর আমতলী এলাকা থেকে নুরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নুসরাত হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি নুরুদ্দিন। তাকে গ্রেপ্তারের পর ফেনী পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানিয়েছে সূত্র। অভিযুক্ত নুরুদ্দিন অধ্যক্ষ এএসএম সিরাজউদ্দৌলার মুক্তি দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। প্রত্যক্ষদর্শী আমতলী গ্রামের শ্রমিক নেতা সফিকুল ইসলাম সফিক জানান, নুরুদ্দিন ঢাকার খিলক্ষেত থেকে বৃহস্পতিবার রাতে আমতলী গ্রামে আকবরের বাড়িতে আত্মগোপন করে।

আকবরের মামির গ্রামের বাড়ি ও নুরুদ্দিনের বাড়ি একই এলাকায়। সেই সুবাদে সে সেখানে আত্মগোপন করেন। তবে নুরুদ্দিনকে গ্রেপ্তারের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি পুলিশ। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই নোমানের করা মামলায় এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নুরুদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের।

কে এই নুরুদ্দিন নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে নুরুদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম গা ঢাকা দেন। ঘটনার প্রথম দিন থেকেই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এ দুজন। ঘটনার মূল আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নুরুদ্দিন ও শাহাদাত। নুসরাতের গায়ে যে চার বোরকাধারী আগুন দিয়েছে, তাদের নামধাম এ দুজন জানেন বলে পুলিশের ধারণা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ৫ এপ্রিল রাতে নুরুদ্দিন ও শাহাদাতকে এবং পরদিন (ঘটনার দিন) সকালে নুরুদ্দিনকে মাদ্রাসার মূল ফটকে দেখা যায়। নুরুদ্দিন ও শাহাদাত দুজনই সোনাগাজী মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র। মাদ্রাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়ায় নুরুদ্দিনের বাড়ি। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় নিয়মিতই মাদ্রাসায় প্রভাব খাটাতেন। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দাখিল পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে সেই টাকা অধ্যক্ষসহ ভাগাভাগি করে নেন।

অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বহু অপকর্মের সঙ্গী এই নুরুদ্দিন ও শাহাদাত। গত ২৭ মার্চ সিরাজউদ্দৌলা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মুক্তির দাবিতে ‘সিরাজউদ্দৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। ২০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক নুরুদ্দিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক হন শাহাদাত হোসেন। তাদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। পিবিআইপ্রধান বনোজ কুমার মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্তের অগ্রগতি হচ্ছে। শিগরিরই ঘটনার সুরাহা হবে বলে আশা করি।’

মানবাধিকার কমিশনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন গতকাল বেলা সাড় ১২টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্তবিষয়ক পরিচালক আল মাহমুদ ফয়েজুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার মাস্টারমাইন্ড হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এবং ঘটনা ঘটিয়েছে অভিযুক্ত তার শুভাকাক্সক্ষী, সহযোগী ও দোসররা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত ২৭ মার্চ যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তা হলে ৬ এপ্রিলের ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব হতো। ২৭ তারিখের ঘটনার জেরেই ৬ তারিখের ঘটনাটি ঘটেছে।’ মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফয়েজুল কবিরসহ তদন্ত দল প্রথমে ঘটনাস্থল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তদন্ত দল প্রধান অভিযুক্ত আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার অফিসকক্ষ ও যেখানে নুসরাতকে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়, সে স্থান পরিদর্শন করেন।

পরে তদন্ত দল নিহত নুসরাতের বাসস্থান সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়ায় মেজো হুজুরের বাড়ি যান। সেখানে তদন্ত দল নুসরাতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ।

পরে আল মাহমুদ ফয়েজুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘নুসরাতের হত্যাকা-টি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ২৭ মার্চ ঘটনার পর যদি কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন সক্রিয় থাকত, তা হলে ৬ এপ্রিলের ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।’ নুসরাতের চাচা শামীম বলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে অনেক আগ থেকে যৌন হয়রানি, চেক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।’

এ মামলার তদন্ত কর্মকতা পিবিআইর পরিদর্শক মো. শাহ আলম বলেন, ইতোমধ্যে ৯ আসামির রিমান্ড চলছে। আমরা চার আসামিকে জোরালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আমাদের তদন্ত চলছে। আমাদের বিভিন্ন টিম দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। এদিকে নুসরাতের বাড়ির পাশে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে নুসরাতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। অন্যদিকে নুসরাত হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে বাদ জুমা মানববন্ধন করেছে উপজেলা ছাত্রলীগ।

সোনাগাজী জিরো পয়েন্টে আয়োজিত মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব চৌধুরী রবিন। এ সময় শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী মানববন্ধনে অংশ নেন। উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। এ সময় কৌশলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

পাঁচ দিন লড়াই করে বুধবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে মারা যান নুসরাত। এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ওই দিনই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ।

Comment here