আতঙ্কের মার্চ সংকটের এপ্রিল - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

আতঙ্কের মার্চ সংকটের এপ্রিল

সুমন মজুমদার : যুগের পর যুগ গেছে, কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে কত সময়। কিন্তু এমন আতঙ্কময় মার্চ মাস হয়তো এ প্রজন্মের অনেকের জীবনে আর যায়নি। নানা সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, সন্ত্রাস নানা কারণে শত শত মানুষ মরেছে। কিন্তু দেখা গেছে তার সবগুলোই ছিল হয়তো একটি অঞ্চলকেন্দ্রিক। কিন্তু গত জানুয়ারিতে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের বণ্য প্রাণীর অবৈধ বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া নোবেল করোনা ভাইরাস যে এভাবে দুই মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর রাজত্ব কায়েম করবে তা হয়তো ভাবতে পারেনি কেউই।

বর্তমানে অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে। যার জেরে গতকাল ১ এপ্রিল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রাণ গেছে ৪৪ হাজারের বেশি মানুষের। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার। নানা গবেষণা সত্ত্বেও বিশ্বের কোনো দেশ এখনো কোভিড-১৯ (করোনা) রোগের প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কার করতে না পারায় লাশের সারি কেবল দীর্ঘই হচ্ছে। করোনার উৎসভূমি চীনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমলেও কমিউনিটি সংক্রমণের জেরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য। করোনা সংক্রমণ প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকাতেও। সব মিলেয়ে এক বিভীষিকাময় মার্চ শেষে তুমুল আশঙ্কার এপ্রিল শুরু করল বিশ্ব।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমানে বিশ্ব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকালে সংস্থার মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই মন্তব্য করেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

তিনি বলেন, ‘এ সংকট বিশ্বজুড়ে এমন মন্দা নিয়ে আসতে পারে সম্ভবত যার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। নতুন ভাইরাসটি সমাজের মর্মমূলে আঘাত হানছে। এটি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে। জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর থেকে কোভিড-১৯ আমাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।’ এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ও মহামারীর ইতি ঘটাতে সব দেশকে আশু সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে গুতেরেস বলেন, না হলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া রোগটির দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বজুড়ে আড়াই কোটি কর্মসংস্থান নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগের ধারা ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলেও দেওয়া হয়েছে পূর্বাভাস।

আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চীন ছাড়িয়ে গত ফেব্রুয়ারির শেষদিন পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগটি ছড়িয়ে ছিল ৫৭টি দেশে। মোট আক্রান্ত ৮৫ হাজার ও মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। যার মধ্যে সিংহভাগ আক্রান্ত ও মৃত্যু ছিল চীনে। কিন্তু মার্চের শুরু থেকেই যেন এই রোগ বিশ্বজুড়ে ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। মার্চের প্রথম দিনই একলাফে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৮৭ হাজার; বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। মার্চের প্রথম দিনে এসে দেখা যায়, চীন ছাড়াও এই রোগে রীতিমতো ধুঁকছে পশ্চিম ইউরোপের ইতালি, মধ্যপ্রাচ্যের ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইতালিতে এদিন একলাফে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৯ জনে দাঁড়ায়, আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১২৮। ইরানে এদিন ২১০ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মারা যায় ১৮ জন। এরপর থেকে শুধু বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর গ্রাফ কেবল লম্বা হওয়ার গল্প।

মার্চের ১০ তারিখে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইতালি ও স্পেনে। বিশ্বজুড়ে এদিন আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়ে গেছে এক লাখ ১৬ হাজার এবং মারা গেছে ৪ হাজারের বেশি মানুষ। এদিন থেকেই গোটা ইতালি লকডাউন করার পরিকল্পনার কথা জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্তে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এরপর একে একে স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশও একই পথে আগায়। বন্ধ করা হয় আন্ত-সীমান্ত ও নৌ-বিমান ও সড়ক যোগাযোগ। রাজধানীসহ অনেক এলাকা লকডাউন হয় এশিয়ার দেশগুলো থেকে শুরু করে ওশেনিয়া ও আফ্রিকার অঞ্চলের দেশগুলোরও। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, সামাজিক যোগাযোগ। মানুষ বন্দি হয়ে পড়ে ঘরে। বড় বড় শহরগুলো পরিণত হয় বিরানভূমিতে।

কিন্তু তবুও করোনার অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণ রোখা যায়নি। দেখা যায় মার্চের শুরুর সঙ্গে তুলনায় শেষদিন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার, মারা যাচ্ছে প্রায় ১৪শ মানুষ। এর মধ্যেই আক্রান্তের তালিকায় সবাইকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যুর তালিকায় চীনকে ছাড়িয়ে উঠে এসেছে ইতালি ও স্পেন। যার সংখ্যা প্রতিদিনই কেবল রেকর্ডসংখ্যক হারে বাড়ছেই। সর্বশেষ ৩১ মার্চ বিশ্বজুড়ে প্রাণ গেছে ৪৫৩৩ জনের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ৯১২, ইতালিতে ৮৩৭, স্পেনে ৭৪৮, ফ্রান্সে ৪৯৯, জার্মানিতে ১৩০, ইরানে ১৪৫সহ বিভিন্ন দেশে প্রাণ গেছে বহু মানুষের।

এপ্রিলের শুরুর দিনটিও নতুন কোনো আশার খবর নিয়ে আসতে পারেনি বিশ্ববাসীর জন্য। গতকালও বিশ্বজুড়ে প্রাণ গেছে প্রায় ২ হাজার মানুষের। এর মধ্যে স্পেনে ৫৮৯, যুক্তরাজ্যে ৫৬৩, ইরানে ১৩৮, বেলজিয়ামে ১২৩, নেদারল্যান্ডসে ১৩৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৪, জার্মানিতে ৪৬, সুইজারল্যান্ডে ২৪, পর্তুগালে ২৭ জনসহ অন্যান্য দেশেও কমবেশি প্রাণহানি হয়েছে।

এরইমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ে অসহায়ত্ব ব্যক্ত করেছে ইতালি ও স্পেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছে তারা। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোও করোনা সংকটের মধ্যে থাকায় তারা কেউই এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। চলতি এপ্রিলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত। এই অবস্থাতেই আইস্যুলেশনে থেকে জনসন এক অনলাইন ভাষণে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার আগে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। প্রয়োজনে কঠোরতম কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রবাসীর জন্যও চলতি এপ্রিল দুঃস্বপ্নের স্মৃতি হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সামনের দুটো সপ্তাহ হবে খুবই বেদনাদায়ক- খুব কষ্টকর দুটো সপ্তাহ। আমি চাই, সামনে যে খারাপ সময় আসছে, আমেরিকার মানুষ সেজন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুক।’ আক্রান্তের মতো করোনায় মৃতের সংখ্যায়ও এদিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৮৯ হাজার ও মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ডা. অ্যান্থনি ফাউসি হুশিয়ার করেছেন, দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সেখানে ১০ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত ও ২ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও স্বীকার করেছেন, মৃতের সংখ্যা এক লাখ বা এর নিচে থাকলে সম্মিলিতভাবে করা খুব ভালো কাজ হবে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা সংক্রান্ত সামাজিক নিয়মগুলো জারি থাকবে। কারণ, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে।

Comment here