এই দম্পতি লাখ টাকা দিলেই ‘সার্টিফিকেট’ দিতেন - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
শিক্ষাঙ্গন

এই দম্পতি লাখ টাকা দিলেই ‘সার্টিফিকেট’ দিতেন

আদর্শ দম্পতি হিসেবে এলাকায় আল ফারাবি মো. নুরুল ইসলাম ও মোসা. আকলিমা খাতুনের রয়েছে বেশ সুখ্যাতি। শিক্ষিত ও সুশীল হিসেবে সকলের কাছেই তারা বেশ সম্মানীয়। এই সম্মানকেই পুঁজি করে ফারাবি দম্পতি বগুড়া সদর থানার কলেজ রোডের সাধারণ বীমা ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ১২টি ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’। সেখানে পেতেছিলেন ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ। লাখ টাকা দিলেই তাদের কাছে মিলত ডিপ্লোমা কোর্সের ভুয়া সার্টিফিকেট।

কলেজ রোডের ওই ভবনে ভুয়া চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিএড কলেজ, প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট খুলে চারুকলা ডিপ্লোমা কোর্স এবং গন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান ডিপ্লোমা কোর্সের নামে প্রতারক এই দম্পতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এ পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন ৭ কোটি ৩১ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৮ টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী ও এক শিক্ষকের অভিযোগের ভিত্তিতে আজ রোববার ঢাকা থেকে ফারাবি মো. নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মোসা. আকলিমা খাতুনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম টিমের সদস্যরা।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শারমিন জাহান আমাদের সময়কে জানান, গ্রেপ্তার আল ফারাবি ও তার স্ত্রী বগুড়া শহরে ভাড়া নেওয়া একটি ভবনের মাত্র দুটি ফ্লোরে ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, নুরুল ইসলাম ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, নিয়াক মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (পলিটেকনিক), বগুড়া টিএইচবিপিইডি কলেজ, এসবি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজ, পাবলিক হেল্থ ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, শহীদ মোনায়েম হোসেন বিএড কলেজ, টিএইচবিপিএড কলেজ, নুরুল ইসলাম আকলিমা প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড বি এম কলেজ, রংপুর অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট ও অ্যাকাডিমিক অ্যান্ড প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট।

অনুমোদিত এসব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কৌশলে অনুনোমোদিত ‘চারুকলা ডিপ্লোমা কোর্স’ এবং ‘গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান ডিপ্লোমা কোর্স’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেন ওই দম্পতি। প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার আড়ালে চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটসহ একাধিক অনুমোদনবিহীন নাম-সর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে চাকরি-প্রত্যাশী বেকার যুবকের কাছে চারুকলা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট বিক্রি করে বিপুল অবৈধসম্পদ অর্জন করেছেন তারা। এ ছাড়া প্রত্যেক উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরির সুযোগের কথা উল্লেখ করে এই দম্পতি পাশ করার নিশ্চয়তা দিয়ে বেকার শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতেন। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ওই দম্পতি এ পর্যন্ত ডিপ্লোমা কোর্সের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৭ কোটি ৩১ লাখেরও বেশী টাকা আত্মসাৎ করেছেন, যা প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত। তাদের এই টাকা আদালতের আদেশে বর্তমানে অবরুদ্ধ।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও জানান, ফারাবি দম্পতির মালিকানাধীন এসবি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজ, বগুড়া টিএইচবিপিইডি কলেজ এবং শহীদ মোনায়েম হোসেন বিএড কলেজের নামে প্রচারিত লিফলেটে চারুকলা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তির বিষয়ে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত’ উল্লেখ করা প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি দেখে ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, (পরিচালক, রাজশাহী আঞ্চলিক কেন্দ্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) বাদী হয়ে একটি মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করেন (বগুড়া সদর থানার মামলা নং-৯২, তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০১৬)। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তে গিয়ে ভুয়া ‘সনদ’ বিক্রি করে কোটিপতি বনে যাওয়া ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডির পরিদর্শক ইব্রাহিম হোসেন জানান, নরুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিভিন্ন ব্যাংকের অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নজরে আসে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অর্থের উৎস যাচাই করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী সম্পর্কে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

পরিদর্শক ইব্রাহিম আরও জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের সনদ নিলে স্কুলে চাকরি পাওয়া যাবে বলে নিশ্চয়তা দিতেন নুরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী। আর এ জন্য প্রতি সার্টিফিকেট থেকে তারা এক লাখ টাকা দাবি করতেন। সরল বিশ্বাসে গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানে গিয়ে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে প্রতারিত হলেও কোনো কিছু বলার সাহস ছিল না। তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে চারুকলা ডিপ্লোমা কোর্সের ৪৩৬জন শিক্ষার্থীর তালিকা পাওয়া গেছে। এসব শিক্ষার্থী ছাড়াও আরও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে ৭ কোটি ৩১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের ২৪টি অ্যাকাউন্টে জমা করেছে তারা। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে সাউথ ইস্ট, আইএফআইসি, এবি, ঢাকা ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক।

শুধু নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর নামে নয়, তাদের দুই সন্তান ও শ্যালিকার নামেও অ্যাকাউন্ট খুলে এসব টাকা জমা করা হয়েছিল। মানিলন্ডারিং আইনের ওই মামলা ছাড়াও ওই দম্পতির বিরুদ্ধে এর আগে অনুমোদন ছাড়া প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিযোগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপও মামলা করেছে। গ্রেপ্তার দম্পতিকে আগামীকাল সোমবার আদালতে তুলে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হবে। রিমান্ডে এই চক্রের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও সিআইডি পরিদর্শক ইব্রাহিম হোসেন জানান।

Comment here