কতটা সফল হলো ডাকসু নির্বাচনের ১ বছর - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
শিক্ষাঙ্গন

কতটা সফল হলো ডাকসু নির্বাচনের ১ বছর

মেহেদী হাসান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের এক বছরপূর্তি হচ্ছে আজ বুধবার। দীর্ঘ ২৮ বছর অপেক্ষার পর ডাকসু নির্বাচন হয় গত বছরের ১১ মার্চ। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২৩ মার্চ। সে হিসাবে এ মাসেই ডাকসুর মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে। গত এক বছরে এ সংগঠন কতটা সফল হলো, শিক্ষার্থীদের জন্য তারা কী করেছে তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আলোচনা।

বহুল প্রত্যাশিত এ নির্বাচনের পর ডাকসু নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা জন্ম নেয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রত্যাশা পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ডাকসু। একসময় দেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ডাকসু ছিল অনেকটাই নিষ্প্রাণ, নিশ্চল। কার্যনির্বাহী কমিটির সম্পাদক ও সদস্যরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ করলেও শিক্ষার্থীদের মূল কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। সংঘাত, আলোচনা-সমালোচনা নিয়েই কেটেছে ডাকসুর এই একটি বছর।

ডাকসুতে নির্বাচিত ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দুই প্যানেলেরই নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিলÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট নিরসন, গণরুম-গেস্টরুমপ্রথা উচ্ছেদ, হল থেকে অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন, সান্ধ্যকোর্স বন্ধ, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, পরিবহন সমস্যার সমাধান, ক্যান্টিনে খাবারের মান বৃদ্ধি, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, ক্যাম্পাসে বাইরের যান চলাচল বন্ধ প্রভৃতি। এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি ডাকসু নেতৃবৃন্দ। তবে এর পরও সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা চাচ্ছেন ডাকসু নির্বাচনের এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে তাদের কল্যাণে ভূমিকা রাখুক ডাকসু।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনের দ্বন্দ্ব নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ডাকসুর কার্যক্রমে। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ছিল প্রকট। ভিপি-জিএসের মধ্যে দূরত্ব, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ এবং ছাত্রলীগের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রতি আকর্ষণ, সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি কারণে ডাকসু তার কার্যক্রম সঠিকভাবে চালিয়ে যেতে পারছে না। তবে কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না থাকায় ডাকসুর নিয়মতান্ত্রিকতার সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন না প্রতিনিধিরা।

ডাকসুর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নেওয়া দৃশ্যমান উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বিভাগের উন্নয়ন ফি কমানো, হলের ফি কমানো, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজন, সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ, ছাত্রী হলসহ বিভিন্ন রুটে পরিবহন বৃদ্ধি, লাইব্রেরি খোলার সময়সীমা দুই ঘণ্টা বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণে ট্যালেন্ট হ্যান্ট প্রতিযোগিতার আয়োজন, অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা চালু ইত্যাদি। এসব কাজও বিচ্ছিন্নভাবে ডাকসুর কিছু সদস্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যাÑ ‘গণরুম’ ‘গেস্টরুম’প্রথা এখনো চালু রয়েছে নতুন আঙ্গিকে। গণরুম হয়েছে ‘বন্ধুরুম’, গেস্টরুম হয়ে উঠেছে ‘মতবিনিময় কক্ষ’। অথচ কার্যক্রম চলে আগের মতোই। শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। গণরুম সমস্যাকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের দলীয় প্রোগ্রামে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ নিয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ২৮ বছর ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল সোনার হরিণের মতো। নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পরিমাণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার অনেকাংশই পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ডাকসু নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এদিকে সদিচ্ছা ও অর্থায়নের অভাবেও বাস্তবায়নযোগ্য অনেক প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না। তবে প্রতিশ্রুতিতে ছিল না, এমন ইতিবাচক কাজও তারা করেছেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো কাজ হয়েছে।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ভেবেছিলাম ডাকসু হলে সব সমস্যা সমাধান হবে, কিন্তু সব আগের মতোই আছে। হলের সব কিছুর ক্ষমতা এখনো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে। এখনো অছাত্ররা রুমে থাকে, আর আমরা নিয়মিত ছাত্ররা হলের বারান্দায় থাকি।

ছাত্রলীগ-ছাত্র পরিষদ দ্বন্দ্বছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ২৩ জন এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের দুজন প্রতিনিধির মধ্যে দ্বন্দ্ব ডাকসুর কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ২৩ জন ডাকসুর ব্যানারে একটি কর্মসূচি পালন করলে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে নির্বাচিত ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক সেখানে থাকেন না। আবার ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক কোনো কর্মসূচি নিলে ছাত্রলীগের নির্বাচিতরা এতে থাকেন না। দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গেও ডাকসুর কোনো যোগাযোগ নেই। ছাত্রলীগ তাদের মতো করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ডাকসুর নামে।

আনুষ্ঠানিকতায় ব্যয় বেশিডাকসু হওয়ার পর থেকে দিবস ও উপলক্ষ-সম্পর্কিত প্রোগ্রাম হয়েছে বেশি। এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ব্যয়ও হয়েছে বেশি। এর বাইরে মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানে কোনো কাজ নেই ডাকসুর। ডাকসু থেকে পাওয়া এই কমিটির প্রথম ১০ মাসের হিসাবে দেখা যায়, ১০ মাসে ডাকসুর ব্যয় ৮৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে ডাকসুর অফিস খরচ বাবদ ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বাকি ৮৩ লাখ ৫১ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ লাখেরও বেশি ব্যয় হয়েছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়।

ছাত্রলীগের নির্বাচিতদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্যও স্তিমিত হয়ে ছিল ডাকসুর কার্যক্রম। দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছাত্রলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে সমন্বিতভাবে কাজ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনা ও রিকশা ভাড়া নির্ধারণ করা নিয়ে ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকত ও নজরুল ইসলামের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এর একদিন পর একই বিষয়ে আরেকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও পরিবহন সম্পাদক শামস-ই নোমান। ডাকসু নেতৃবৃন্দের পাল্টাপাল্টি এমন বিজ্ঞপ্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

নির্বাচনের পর থেকে কোনো কাজে দেখা যায়নি ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটারিয়াবিষয়ক সম্পাদক লিপি আক্তার, সদস্য নিপু ইসলাম তন্বী ও সাবরিনা ইতিকে। প্রথম এক মাস মাঠে সক্রিয় থাকলেও পরে বিয়ে করে সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন লিপি। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে লিপি জানান, তিনি সপ্তাহে দু’একবার ক্যাম্পাসে আসেন এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করেন। নিপু ইসলাম জানান, সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে এক হয়ে তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। তবে সেগুলোর প্রচার না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা জানতে পারেননি। সাবরিনা ইতি বলেন, কোনো সম্পাদক প্রোগ্রাম করলে সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তবে আমি নিজে কোনো প্রোগ্রাম করিনি।

ছাত্রলীগের অসহযোগিতাকে দায়ী করে ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ডাকসুর পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু কাজ করা হয়েছে। তবে মোটা দাগে শিক্ষার্থীদের যে মৌলিক চাহিদা রয়েছে, সেটি নিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারিনি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের যে প্রধান সমস্যা আবাসিক সংকট নিরসন এবং হল থেকে অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন করে বৈধ শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর হয়নি। প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং ছাত্রলীগের প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব সম্ভব হয়নি। ছাত্রলীগ মুখে সহযোগিতার কথা বললেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যায় না। কোনো কাজ করার উদ্যোগ নিলেও সেখানে ছাত্রলীগের বাধা আসে। নুর জানান, একাধিকবার জিএস-এজিএসকে গণরুম-গেস্টরুম বন্ধের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছেন তিনি। কিন্তু তারা উদ্যোগ নেননি। উপাচার্যও ছাত্রলীগের সুরেই কথা বলেন।

তবে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে শিক্ষার্থীরা যেসব সুবিধা পায়নি, ডাকসুর কল্যাণে সেসব সুবিধা পেতে শুরু করেছে। ডাকসুকে সফল হিসেবে দেখেন এর এজিএস সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জবাবদিহিমূলক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা ডাকসুর প্রথম সফলতা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমাধান করেছে ডাকসু। যখনই শিক্ষার্থীরা কোনো প্রয়োজন নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে, তাৎক্ষণিকভাবেই সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি।

ডাকসুর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানও। তিনি বলেন, ডাকসু বিভিন্নভাবে অনেক কর্মসূচি করছে এবং সেগুলোতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততাও দেখা গেছে। এগুলো দেখে খুব ভালো লাগছে। এত অল্প সময়ে তারা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে ডাকসুর কার্যক্রম সম্পর্কে শিক্ষার্থীরাই ভালো মতামত দিতে পারবেন বলেও মনে করেন উপাচার্য।

Comment here