কড়া শর্তে রেল দিচ্ছে চড়া মূল্য - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

কড়া শর্তে রেল দিচ্ছে চড়া মূল্য

তাওহীদুল ইসলাম : খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোই টার্গেট। তা ছাড়া পর্যটকদের ট্রেনের মাধ্যমে সুন্দরবনে ভ্রমণের সহজ ব্যবস্থা করার চিন্তা থেকেও উদ্যোগটি নেয় সরকার। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণে খোদ জনপ্রতিনিধিরা আপত্তি জানিয়েছেন।

এ ছাড়া দরপত্রের শর্তের কারণে নির্মাণকাজের একটা অংশ আটকে আছে। ফলে দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েও রেলপথটি নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। সংশোধিত এ প্রকল্পের মেয়াদ আছে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এক যুগ আগে নেওয়া প্রকল্পটি কীভাবে সম্পন্ন করা হবে ক‚লকিনারা পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ সময়ে প্রকল্প পরিচালক পদেও পরিবর্তন এসেছে বহুবার। এখন দরপত্রের পদ্ধতি পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে সরকার।

জানা গেছে, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেলপথটির খুলনায় ২৯.৬৫৬ কিলোমিটার ও বাগেরহাটে ৩৫.১০ কিলোমিটার। এজন্য খুলনা জেলায় ৩৮৫ একর ও বাগেরহাট জেলায় ২৮৭ একর জমি লাগবে। এর মধ্যে বাগেরহাট জেলায় ৪টি স্টেশন অ্যাপ্রোচ রোডের জন্য প্রায় ১২ একর জমি দরকার। কিন্তু পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে ওই অঞ্চলের দ্বিগরাজ স্টেশনসংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ না করতে ডিও লেটার দিয়েছেন। হাবিবুন নাহারের স্বামী খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকও এ নিয়ে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় ব্যক্তির আপত্তির কারণে সেখানকার ৯৪৭ দাগের জমি অধিগ্রহণ করতে বারণ করেন জনপ্রতিনিধিরা।

এ নিয়ে রেলের কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে দেখা করে স্টেশন অ্যাপ্রোচ রোডের অবস্থান পরিবর্তনে আইনি সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। পরে দ্বিগরাজ স্টেশনের অ্যাপ্রোচ রোডের প্রস্তাবিত বিদ্যারাবাওন মৌজার জমি বাদ দিয়ে ভাগা, চুলকাটি বাজার, কাটাখালী স্টেশন অ্যাপ্রোচ রোডের ৬টি মৌজার জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বিপত্তি রয়ে গেছে ওই দ্বিগরাজ স্টেশন অ্যাপ্রোচ রোডের জমি অধিগ্রহণে। এ ছাড়া মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ৮৯ একর, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের ০.৯৮৯৪ একর, বাগেরহাট জেলার সরকারি মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের অধীনস্থ জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফাইল চালাচালি চলছে। এখনো এসব জমি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর না হওয়ায় ভবিষ্যতে জটিলতার আশঙ্কা আছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে সাম্প্রতিক বৈঠকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রকল্প পরিচালক আরিফুজ্জামান বলেন, ভ‚মি অধিগ্রহণে কিছু সমস্যা আছে। আশা করি সেগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। জনপ্রতিনিধিদের আপত্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। বাকি কাজ শেষ হোক। আবারও যোগাযোগ করব। জনস্বার্থ বিবেচনায় আশা করি এ অংশের ব্যাপারে আর দ্বিমত করবেন না।

এদিকে, জমি অধিগ্রহণ ছাড়াও রেলপথটি নির্মাণে আরেকটি বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে দরপত্রের শর্ত জটিলতা। এ কারণে প্রকল্পের ‘প্যাকেজ-৩’ সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ থমকে আছে। ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের অধীনে অপটিক্যাল ফাইবার কাজের জন্য দরপত্র আহŸান করেও দুবার তা বাতিল করতে হয়েছে। কারণ প্রাক্কলিত দরের চেয়ে দরপ্রস্তাব আসে বহুগুণ বেশি। নির্দিষ্ট দেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের শর্তের কারণে প্রকল্পের এ প্যাকেজে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে। আর দরপত্রের ধরন পরিবর্তন করলে প্রাক্কলিত দরের মধ্যেই প্যাকেজটি বাস্তবায়ন সম্ভব; এতে বিপুল অঙ্কের অর্থের সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একই যুক্তিতে এ অংশের ব্যয় প্রকল্প সাহায্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র (এনসিটি) আহŸানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) চিঠি দিতে যাচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সিগন্যালিং প্যাকেজ বাস্তবায়নে ইআরডি ও পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। কারণ এ নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে দরপত্রের পদ্ধতি পরিবর্তনের ব্যাপারে মত এসেছে। আশা করি এতে আর দরপত্র বাতিল করতে হবে না এবং খরচ সাশ্রয় হবে।

সূত্র মতে, অপটিক্যাল ফাইবার কাজের জন্য ডিপিপিতে ২২ কোটি ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা ধরা হয়। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ১৭ কোটি ৭৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা ও সিডি ভ্যাট (জিওবি ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা)। সংশোধিত ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী ভারতীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলে প্রথমবার ৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। দরপত্র জমা দেয় দুটি প্রতিষ্ঠান; সেখানে প্রাপ্ত দর প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৩৩.৮২ শতাংশ বেশি হওয়ায় দরপত্রটি বাতিল হয়। এর পর দ্বিতীয়বার ডাকা দরপত্রে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও দরপত্র জমা দেয় দুটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রাপ্ত দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৫৭.১০ শতাংশ বেশি হওয়ায় দরপত্রটি বাতিল করা হয়। এমন বাস্তবতায় দরপত্র চ‚ড়ান্তকরণে ডাকা হয় প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) সভা। সেখানে রাষ্ট্রীয় খাতে স্থানীয়ভাবে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মত দিয়ে তা প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) উত্থাপন করার কথা হয়। এর পর একই বিষয়ে পিএসসি সভায় সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজের জন্য এনসিটি পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বানের মত দিয়ে বলা হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিতে। সে অনুযায়ী গত ২ ফেব্রুয়ারি রেলসহ ইআরডি, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক ও এমইএর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জুম মিটিং হয়। ওই বৈঠকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি ও ইআরডির মাধ্যমে ভারতীয় হাইকমিশনে প্রস্তাবটি তুলে ধরতে বলা হয়। সে অনুযায়ী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হচ্ছে এ বিবেচনায় এখনই কাজটি শুরু করা দরকার বলে চিঠি দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।

খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পটি সর্বশেষ সংশোধিত একনেকের মাধ্যমে অনুমোদন মেলে গত বছরের ৫ অক্টোবর। সে অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ। সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্র্র্থ ১ হাজার ৩১২ কোটি এবং প্রকল্প ঋণ ২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৮.০২ শতাংশ।

 

Comment here