চার বছর পরও ঘাতককে জানতে পারল না পুলিশ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

চার বছর পরও ঘাতককে জানতে পারল না পুলিশ

হামিদ উল্লাহ চট্টগ্রাম : সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে কারা খুন করেছে তা চার বছরেও জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তিনটি সংস্থা ঘুরে আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তাধীন। তবে মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে চলেছেন, বাবুল আক্তারই মিতুর হত্যাকারী।

মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেন, আমি বাবা। আমার মেয়েটাকে কারা খুন করল, সেটা কি আমার জানার অধিকার নেই? আমার মেয়ের খুনের বিচার পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই? আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। আসল খুনি বাবুল আক্তার। সে যাতে কোনোভাবে রক্ষা না পায়, আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছেও যদি বিচার না পাই, এ বিচারের ভার আমি আল্লাহর কাছে দিলাম।

২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে নগরীর জিইসি মোড়ে নিজ ভাড়া বাসার কিছু দূরে গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। সেই হিসেবে গতকাল শুক্রবার এ ঘটনার চার বছর পূর্ণ হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ মামলাটি সাড়ে তিন বছর ধরে তদন্ত করে। কিন্তু কার্যত কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। তবে গত পাঁচ মাসেও পিবিআই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেনি বলে জানা গেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাঈন উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেছি। এখন এটি তদন্তের পর্যায়ে আছে।

গত চার বছরের প্রায় সময়জুড়ে মামলাটির তদন্তভার ছিল সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের কাছে। তিনি বলেন, গত জানুয়ারিতে আদালত সুয়োমোটা জারি করে মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দিয়েছেন। এর পর আমরা সব নথিপত্র পিবিআইকে বুঝিয়ে দিয়েছি।

তবে মামলার তদন্তভার পিবিআইয়ে যাওয়ার পরও ন্যায়বিচারের কোনো আশা দেখছেন না মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, নিয়ম হচ্ছে মামলার তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে সেটা বাদী কিংবা বাদীপক্ষ অথবা ভিকটিমের পরিবারকে জানাতে হবে। বাদী বাবুল আক্তার নিজেই সন্দিগ্ধ। তা হলে গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্য তো মিতুর বাবা হিসেবে আমাকে বিদায়ী তদন্ত কর্মকর্তা অথবা নতুন তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো উচিত ছিল। তারা তা জানায়নি।

২০১৬ সালে হত্যাকা-ের বছরখানেক পর থেকেই মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছিলেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে মিতুকে খুন করা হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ তোলেননি কেন জানতে চাইলে সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বাবুলের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধব, এর মধ্যে পুলিশ আছে, সাংবাদিকও আছে, তারা শুরু থেকেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। পরে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, তারা আমাদের সামনে ভালো সেজে আমাদের গতিবিধি অনুসরণ করছে। পরে সেটা বাবুলকে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। সেটা জানার পর আমি তাদের এড়িয়ে চলা শুরু করি। তখন আমার সামনে অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়।

এ ধরনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। ফলে এ ব্যাপারে তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি। গত চার বছর ধরে অনেকটা নিশ্চুপ আছেন মামলার বাদী বাবুল আক্তার। পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকার মগবাজারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি।

পুলিশের তদন্তে আস্থা না থাকার কথা জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি নিজে পুলিশ অফিসার ছিলাম। আমি অনেক মামলা তদন্ত করেছি। আমার ধারণা, মিতু খুন হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই তদন্তে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক কিছু জানতে পারেন। তারা জানতে পারেন, বাবুল আক্তার হত্যাকাণ্ডে জড়িত। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি তারা করে ফেলে, যেটা তারা প্রকাশ করতে পারেননি। একটি ঘটনা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি আরও পাঁচটি ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, সেই ভয়ে তারা চুপ করে থাকেন। গত চার বছরে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার নথিতে চারটি লাইন যোগ করেছেন কি না আমার সন্দেহ।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে মিতু খুন হওয়ার ঘটনায় ওই বছরের ৮ জুন ও ১১ জুন নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারি উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিতু হত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।

ওই বছরের ২৪ জুন রাতে ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর ফলে সন্দেহের তীর যায় বাবুলের দিকে। হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন।

২৬ জুন মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে জানান, মিতু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি তাদের দিয়েছিলেন যুবলীগ নেতা এহতেশামুল হক ভোলা।

এর পর পুলিশ ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়, যেটি মিতু হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য।

এর পর ১ জুলাই মোটরসাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভোলা, সাইদুল ও রবিন ইতোমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

Comment here