চালের দাম আরও বাড়ছে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

চালের দাম আরও বাড়ছে

রেজাউল রেজা : পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে অস্থিরতা কাটতে না কাটতেই দাম বাড়তে শুরু করেছে চালের। দেশে কোনো বন্যা, খরা, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান এ খাদ্যদ্রব্যটির দাম দুই সপ্তাহে প্রতিকেজিতে চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজ-রসুনের মতো চাল নিয়েও চলছে কারসাজি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে।

রাজধানীর চালব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে চালের সংকট নেই। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও চালকল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে। ফলে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজিতে সর্বোচ্চ ছয় টাকা পর্যন্ত এখন দাম বাড়তি।

রাজধানীর চালের বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে সরু চালের মধ্যে মানভেদে নাজিরশাইল ৫৫ থেকে ৬০ ও মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা মানভেদে ৪৪ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া আটাশ ৪০ থেকে ৪২ টাকা। মোটা চালের পাইজাম ৩৮ থেকে ৪০ ও স্বর্ণা ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল এসব চাল। এ ছাড়া পোলাও চালেরও দাম বেড়েছে।

কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকায়। গত সপ্তাহেও যা বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

মালিবাগ বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মো. খোরশেদ জানান, খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে না। পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হয়, তাই বাড়তি দামে চাল বিক্রি করতে হয় আমাদের। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।

একই বুলি পাইকার ও আড়তদারদের মুখেও। কারওয়ানবাজারের চালের পাইকারি প্রতিষ্ঠান লাকসাম ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী মো. মোশাররফ হোসেন জানান, দুই সপ্তাহ আগে প্রথমে মিনিকেট চালের দাম বাড়তে শুরু করে। পরে একে একে সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। বর্তমানে মিনিকেটের বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। দুই সপ্তাহ আগে যা ছিল ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। ভালো মানের নাজিরশাইলের বস্তা ৩ হাজার টাকা এবং মাঝারি মানের নাজিরশাইলের বস্তা ২ হাজার ৪০০ টাকা। গত সপ্তাহে যা ছিল যথাক্রমে- ২ হাজার ৭০০ এবং ২ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া ভালো মানের পোলাওর চালের বস্তার দাম বর্তমানে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা।

একই বাজারের আরেক পাইকারি প্রতিষ্ঠান জনতা রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলেন, দাম আমাদের হাতে নেই। চালকল মালিকদের কাছ থেকে বাড়তি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। তাই পাইকারি ও খুচরা বাজারেও দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মিনিকেট চাল এখন শেষের দিকে। তাই দাম বেড়েছে। আগামী বৈশাখের আগে দাম কমবে না।

এদিকে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) তাদের দৈনন্দিন খুচরা বাজারদরের প্রতিবেদনে বলছে চালের দাম বেড়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী গত এক মাসে শুধু সরু চালের দামই ৫ শতাংশ বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। এক মাস আগে ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। অন্য চালের দামও বেড়েছে।

চালকল মালিকদের দাবিÑ ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম সামান্য বেড়েছে। প্রতিমণে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দাম বেড়েছে। তবে চালকল দাম অল্প বাড়লেও বাজারে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেশি হারে বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি মিলারদের। তাদের মতে, দাম বাড়ার পেছনে চালকল মালিকরা দায়ী নন। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে দুষ্টু ব্যবসায়ীচক্র পাইকারি পর্যায়ে দাম বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ অটো, মেজর, হাসকিং ও রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী আমাদের সময়কে বলেন, আমন মৌসুম শেষ হওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে চালের দামেও। এখন সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আমন ধান-চাল সংগ্রহ করছে। এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। চাল সংগ্রহ বন্ধ হলে দাম কিছুটা কমে যাবে।

লায়েক আলী বলেন, দাম বাড়লেও গত বছরের তুলনায় এ বছর চালের দাম তুলনামূলক অনেক কম। এ ছাড়া আমাদের এখানে দাম সামান্য বাড়লেও বাজারে গিয়ে বাড়ছে আরও বেশি হারে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের চালান পরীক্ষা করে দেখেন তারা আমাদের কাছ থেকে কত দামে চাল কেনেন এবং কত দামে বিক্রি করেন। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগে বেশি দাম বাড়াচ্ছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল ও ৩ লাখ ৫১ হাজার টন গম মজুদ আছে। সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মাত্র ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করছে। এ হিসাব অনুযায়ী সংগ্রকৃত চালের পরিমাণ মোট উৎপাদনের তুলনায় খুবই কম। তাই চালের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের যে কথা বলা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সঠিক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চালের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা যেসব কারণ দেখাচ্ছেন, তা ‘খোড়া যুক্তি’ মাত্র। এই সময় চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এর পেছনে কারও না কারও কারসাজি রয়েছে।

সঠিক সময়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুষ্টু ব্যবসায়ীরা আরও সাহসী হয়ে উঠছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং টিম গঠন করলেও শেষ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানা নেই। দাম আগেও বেড়েছে, এখনো সুযোগ পেলে বাড়ছে। যারা অপকর্ম করে তাদের যদি বারবার ছাড় দেওয়া হয়, তা হলে এ ঘটনা বারবার ঘটবে। তাই সঠিক সময়ে সরকার এদের খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।

Comment here