রাজপথের চলমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। পাশাপাশি কূটনৈতিক উইং ঢেলে সাজানো ও দল পুনর্গঠনের প্রতি বিশেষ নজর দেবে দলটি। তবে এই দুই ইস্যুতে তাড়াহুড়া করতে চায় না দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী শনিবার ঘোষিত কালো পতাকা মিছিলে রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের জমায়েতের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। একই সঙ্গে বন্ধু-শত্রু রাষ্ট্র চিহ্নিত করতে কূটনৈতিক উইং ঢেলে সাজানো পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যোগ্যদের দলে জায়গা দিতে একাধিক তালিকা লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আশা করছেন দলের মহাসচিব দ্রুত কারামুক্ত হবেন। এরপর আন্দোলনের সফলতা ও ব্যর্থতা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হবে। তারপর নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আমাদের একটি মাত্র প্রতিজ্ঞা, একটি মাত্র লক্ষ্য আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব। আমাদের গণতন্ত্রের আন্দোলন চলতেই থাকবে। গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।’
স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীকাল শুক্রবার সব জেলা সদরে এবং পরদিন ২৭ জানুয়ারি শনিবার সব মহানগরে কালো পতাকা মিছিল করবে বিএনপি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এটাই দলটির প্রথম কোনো কর্মসূচি।
রাজধানী ঢাকায় মিছিল সফল করতে বিভাগের সব জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে অংশগ্রহণ করা নেতারা বলেন, শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচি সফল করতে দলের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ২৮ অক্টোবরের পর ঢাকায় বড় জমায়েত ঘটাতে চায় দলটি।
একই কর্মসূচি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দাম, কারবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং ‘অবৈধ সংসদ বাতিলের’ এবং সরকারের পদত্যাগসহ একদফা দাবিতে এই কালো পতাকা মিছিল করবে বিএনপি।
২০০৬ সাল থেকে টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। এর মধ্যে ২০১১ সাল থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে দলটি। এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত কোনো ফলাফল পায়নি দলটি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বরাবর শক্তিশালী। দলটি টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারতও আওয়ামী লীগের বিশ^স্ত বন্ধু। রাশিয়া ও চীনও তাদের পক্ষে। এর বিপরীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চীনের সঙ্গে যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তারও উন্নতি হয়নি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে পাকিস্তানকে অবহেলা করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছেও বিএনপি ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ভারত, চীন ও রাশিয়া যেভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দেয়, সেইভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব দলগতভাবে বিএনপিকে সেই গুরুত্ব দেয় না বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে সরকার পতন আন্দোলনের মূল্যায়ন করেছে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থিতিতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা কূটনৈতিক দুর্বলতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিএনপিকে প্রয়োজনে এ প্রক্রিয়ায় নতুন নেতাদের যুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
সম্প্রতি তারেক রহমানের উপস্থিতিতে ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও কূটনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়টি উঠে আসে। এ বৈঠকে বিএনপির কূটনৈতিক অবস্থান ঠিক করার পরামর্শ দেন নেতারা। কারা বন্ধু, কারা শত্রু তা ঠিক করে একটি নীতি তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। নেতারা বলেন, নির্বাচনের আগে ভারতবিরোধী যে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি তা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ দেশের রাজনীতি বিদেশিদের হাতে চলে গেছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতি বিরাজনীতিকরণের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরপর আর রাজনীতি নিয়ে কথা বলার অবস্থা নেই।’
বিএনপি ও সমমনা দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্রে জানা যায়, কূটনৈতিক ব্যর্থতার পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে এবারের আন্দোলনে। এই অবস্থায় দল পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে পরামর্শ দিয়েছেন দলের
স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণ, নির্বাহী কমিটিতে যোগ্যদের পদায়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে যেসব আংশিক কমিটি রয়েছে- তা পূর্ণাঙ্গ করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন পদের বিপরীতে একাধিক নেতার নাম সুপারিশ করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে সিনিয়র নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মো. শাজাহান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবদিন, বরকতউল্লা বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, রুহুল কবির রিজভী, আমানউল্লাহ আমান, খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জহির উদ্দিন স্বপন প্রমুখ নেতাদের নাম রয়েছে।
ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে, মজিবর রহমান সরোয়ার, হারুনুর রশিদ, জয়নুল আবদিন ফারুক, ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দিন খোকন, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, ফজলুল হক মিলন, ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, ডা. শাহাদাত হোসেন, মিজানুর রহমান মিনু, খায়রুল কবির খোকন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু প্রমুখ নেতার নাম এসব তালিকায় রয়েছে।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে হাবিব উন নবী খান সোহেল, যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, এমরান সালেহ প্রিন্স, আজিজুল বারী হেলাল, এবিএম মোশাররফ হোসেন প্রমুখ রয়েছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, হাসান মামুন, আবদুল কাদির ভ্ইূয়া জুয়েল, জিকে গউস, হাজি ইয়াসিন, শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, আব্দুল খালেক, আমিরুল ইসলাম আলিম, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মো. শরিফুল আলম, দপ্তর সম্পাদক হিসেবে তাইফুল ইসলাম টিপুর নাম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, দল পুনর্গঠনের বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেখেন। এ ধরনের তালিকা তার কাজকে সহজ করে দেবে। কোনো কোনো নেতা মহাসচিব হতে বেশ আগ্রহী। কিন্তু মহাসচিব পদে এখনো খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের পছন্দের তালিকায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই আছেন। যদিও বেশ কয়েকবার তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাসচিবের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। শীর্ষ নেতাসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতাকেও তিনি বলেছিলেন। কেউই মির্জা ফখরুলের কথায় সায় দেননি।
Comment here