তেলের মজুদ নিয়ে কারসাজি চরমে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

তেলের মজুদ নিয়ে কারসাজি চরমে

আবু আলী ও রেজাউল রেজা : শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা এলেও সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল মিলছে না দেশের বাজারে। বিক্রি হচ্ছে আগের মতোই উচ্চমূল্যে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বাজারে তেলের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না সয়াবিনের পাঁচ লিটারের বোতল। শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা আসায় দাম নিয়ে বাগ্বিতণ্ডাও চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, তারা চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না। অন্যদিকে পাইকইর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাজারে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ভোক্তাদের অভিযোগ, দেশের ভোজ্যতেলের বাজার পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা লুটছেন। হাতেগোনা কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ভোজ্যতেলের মিলের কারণেই সংকটের উৎপত্তি। মিলাররা সাপ্লাই অর্ডার (এসও) কিংবা ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) অনুযায়ী ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে না। মিলারদের অগ্রিম ‘এসও’ বাণিজ্য সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনও জানান, ঘাটতি না থাকার পরও সয়াবিনের দামবৃদ্ধি অস্বাভাবিক।গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হচ্ছে।

রমজান সামনে রেখে দাম আরও বাড়াতে উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে তেলের সরবরাহ হচ্ছে না। এখন ভোক্তাদের অতিরিক্ত মাসুল গুনতে হচ্ছে। তবে বাড়তি দাম দিয়েও দেশের অনেক জায়গায় ক্রেতারা ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না। সারাদেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন। আর খোলা সয়াবিন ও পামওয়েল পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতিলিটারে প্রায় ৩০-৩৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের হুশিয়ারির পরও বাজারে তেলের মজুদ নিয়ে কারসাজি থেমে নেই। এখনো কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তেলের পাইকাররা বলছেন, ভ্যাট কমানো হলেও শিগগিরই বাজারে এর প্রভাব পড়বে না। সময় লাগবে। কারণ তেল ইতোমধ্যে বন্দর থেকে খালাস হয়ে গেছে। যে তেল বাজারে চলে এসেছে, সেগুলো আগে ফুরাতে হবে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মজুদের খবরও উঠে আসছে বারবার। গত শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবৈধভাবে মজুদ করে রাখা বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময় ৫১২ লিটার সয়াবিন তেলসহ এক অসাধু ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা ঊর্ধŸমুখী হওয়ার পুরো সুযোগটি এবার নিয়েছে মিল মালিকরা। এ কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ভোজ্যতেলের বাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে মিলগুলোতে অভিযান চালানো উচিত। কারণ মিলগুলো থেকে চাহিদামতো ভোজ্যতেলের সরবরাহ করা হচ্ছে না। আর এ কারণে বাজারে তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।

এসও এবং ডিও অনুযায়ী নির্দিষ্ট তারিখে তেল আনতে গেলে মিলগুলো সরবরাহ করছে না বলে জানান বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজী মো. আলী ভুট্টো। তিনি বলেন, খোলা সয়াবিন ও পামওয়েলের সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে দামে।

ভোজ্যতেলের সরবরাহ ও দাম নিয়ে অনিয়ম হচ্ছে কিনা, তা যাচাইয়ে বাজারে অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো। এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে মজুদ করা ভোজ্যতেলও। কিন্তু মিলগুলোয় এখনো সেভাবে অভিযান চালানো হয়নি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশীয় বাজারে দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখনো দেশীয় বাজারে পড়েনি। বাজার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। পাকা রসিদ ছাড়া তেল বেচাকেনা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে বদলে ফেলা হবে বাজার তদারকির ধরন।

আমদানি সন্তোষজনক, তার পরও দাম চড়া

দেশে সয়াবিনের চাহিদা মেটানো হয় দুইভাবে। ছয়টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে; আর সয়াবীজ আমদানি করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন তেল বাজারজাত করে। এ দুইভাবে দেশের বার্ষিক ১২-১৩ লাখ টন সয়াবিনের চাহিদা পূরণ করা হয়। সেই হিসাবে প্রতি মাসে সয়াবিনের চাহিদা রয়েছে এক লাখ টনের কাছাকাছি। তবে রোজায় এই চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয় ৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। আর প্রায় ২৪ লাখ টন সয়াবিন বীজ থেকে পাওয়া যায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন তেল। অপচয় বাদ দিলে কম-বেশি ১২ লাখ টন সয়াবিন আমদানি হয়েছে। আমদানির তথ্যে দেখা যায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় প্রায় ৯৩ হাজার টন।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বাজারজাত হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন। ট্যাংক টার্মিনালে আগের মজুদ থাকায় আমদানির চেয়ে বেশি পরিমাণ তেল বাজারজাতের জন্য খালাস করতে পেরেছে কোম্পানিগুলো। সাধারণত ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাসের পর পরিশোধন করে বাজারজাত করতে এক-দুই সপ্তাহ সময় লাগে। সেই হিসাবে সয়াবিন তেলের একাংশ কোম্পানির কারখানা বা দোকানে বাজারজাতের অপেক্ষায় রয়েছে।

গত বছর রোজার আগে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাজারজাত হয়েছিল ১ লাখ ২১ হাজার টন সয়াবিন তেল। এ বছর একই সময়ে গতবারের চেয়ে ৪৮ হাজার টন বেশি তেল আমদানি হয়েছে। আবার গত বছরের চেয়ে এবার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন বীজ আমদানি বেশি হয়েছে ৪০ হাজার টন। তাতে বীজ থেকে সয়াবিন উৎপাদনও আগের তুলনায় বেড়েছে। এ দুটি তথ্য প্রমাণ করে, বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়।

ভোজ্যতেলের ভ্যাট প্রত্যাহার করায় ব্যবসায়ীদের সুবিধা হলেও ভোক্তারা খুব একটা উপকৃত হবে না বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আরও বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও ভোজ্যতেল বিক্রি হবে সর্বশেষ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী। ভ্যাট প্রত্যাহারের পর নতুন করে দাম হয়তো বাড়বে না, কিন্তু নির্ধারিত দামের চেয়ে কমবেও না। নির্ধারিত যে দাম, সেটাও তো কম আয়ের ভোক্তাদের নাগালের বাইরে।

অগ্রিম এসও বাণিজ্যে সংকট আরও তীব্র

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও মিল মালিকদের অগ্রিম এসও বাণিজ্য ভোজ্যতেলের চলমান সংকটকে আরও তীব্র করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অগ্রিম এসও বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। যারা এসওর মাধ্যমে অগ্রিম অর্ডার দিয়েছেন, তারা এখন ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না।

সূত্র জানায়, নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে আমদানির অনেক আগেই বাজারে ভোজ্যতেলের ডিও (বর্তমানে এসও) ছেড়ে অর্থ তুলে নেয় আমদানিকারকরা। এ সময় নিজেদের সক্ষমতার চেয়েও বেশি ডিও বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে ডিও ও এসওর বিপরীতে মিল থেকে পণ্য উত্তোলনের সময়সীমা থাকে। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে কেউই সময়মতো পণ্যটি সংগ্রহ করে না। বারবার বিক্রির মাধ্যমে একই ডিও অনেক সময় শতাধিক হাত বদল হতেও দেখা যায়।

ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রভাব পড়েনি বাজারে

ঘোষণার দুদিন পরও বাজারে ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রভাব পড়েনি। রাজধানীর বাজারে গতকালও বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৮২০ থেকে ৮৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। অপরদিকে ভালো মানের খোলা তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত এবং সুপার পাম তেল প্রতি কেজি ১৬০ টাকা।

কারওয়ানবাজারের মালিবাগ বাজারের মেসার্স গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা জানান, ভ্যাট প্রত্যাহারের পর কিছু দোকানে দাম সামান্য কমেছে। কিন্তু বেশির ভাগ দোকানেই দাম বাড়তি রয়েছে। কারণ কোম্পানিগুলো এখনো স্বাভাবিক হারে তেলের বোতল সরবরাহ করছে না।

পাইকাররা বলছেন, মিল থেকে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে না এখনো। অবশ্য মিল মালিকরা এই অভিযোগ কখনো স্বীকার করেননি। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের সুফল অবশ্যই বাজারে আসবে। তবে একটু সময় লাগবে। এনবিআর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।

 

Comment here