নুসরাতকে পুড়িয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজাতে বলে সিরাজ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ক্রাইম

নুসরাতকে পুড়িয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজাতে বলে সিরাজ

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার পর তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কারাগারে বসে সেই অংক কষেছিলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা নিজেই। তার নির্দেশমতেই সহযোগীদের নিয়ে সেদিন রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় নুর উদ্দিন ও শামীম। গতকাল রবিবার ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালতে এ বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সিরাজ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল গতকাল রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সিরাজউদ্দৌলা ফেনী কারাগারের কোন স্থান থেকে কীভাবে কার সহায়তা নিয়ে নুর উদ্দিন ও শামীমের সঙ্গে কথা বলেন, সেসব বিষয়েও স্বীকারোক্তি দেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করতে চাননি পিবিআই পুলিশ সুপার।
গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সিরাজউদ্দৌলাকে ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালতে হাজির করা হয়। রাত পৌনে ৯টার দিকে তার জবানবন্দি গ্রহণ শেষ হয়। রাফি হত্যার ঘটনায় তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামালা করেন। এ পর্যন্ত অধ্যক্ষ সিরাজসহ অন্তত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই, যাদের অধিকাংশই ওই মাদ্রাসার ছাত্র। এর মধ্যে আটজন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে এ বছর আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। তাকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার মা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর থেকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু তা না করায় গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ দিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীনে মারা যান নুসরাত। তবে মৃত্যুশয্যায় দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলে যানÑ তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরা চারজন গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পর সন্দেহভাজন কয়েকজনকে পুলিশ ধরলেও ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলছিল না। মামলার তদন্ত ভার পিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পর হত্যাকা-ের মূল সন্দেহভাজন হিসেবে আলোচিত ওই মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন ও শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই কর্মকর্তারা বলছিলেন, ঘটনার দুই দিন আগে কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে আসেন নুর উদ্দিন ও শামীম। নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য বলেন অধ্যক্ষ সিরাজ, কাজ না হলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। পরে সঙ্গীদের নিয়ে মাদ্রাসার একটি হোস্টেলে বৈঠক করে নুর উদ্দিন ও শামীম। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাতকে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে ছাদে নেওয়া হয়। শেষবার মামলা তুলে নিতে বলা হলে নুসরাত তাতে আপত্তি জানান। তখন শামীম, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিসহ পাঁচজন তাকে ফেলে দিয়ে হাত-বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। শামীমসহ ঘাতকরা যে বোরকা পরে ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল, তার একটি এরই মধ্যে খাল থেকে উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা।
সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের নুর উদ্দিন ছিল অধ্যক্ষ সিরাজের ঘনিষ্ঠজন। নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টার মামলায় অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মুক্তি দাবির আন্দোলনেও সামনের কাতারে ছিল এ যুবক। অন্যদিকে একই মাদ্রাসার ছাত্র শামীম প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নুসরাতের ওপর ছিল ক্ষুব্ধ। মাদ্রাসায় পড়ার পাশাপাশি স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমের সহকারী হিসেবেও কাজ করত শামীম। সে হিসেবে এলাকায় তার বেশ প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। নুসরাত হত্যাকা-ের পেছনে এই দুজনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে প্রাথমিক ধারণা করেছিলেন স্থানীয়রা।
শামীমের ল্যাপটপ ও মোবাইল জব্দ : নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও তার মায়ের মোবাইল জব্দ করেছে পিবিআই। গত শনিবার রাতে সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূঞাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে এগুলো জব্দ করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক (ওসি) মো. শাহ আলম জানান, শামীমকে নিয়ে তার বসতঘর ও ভূঞাবাজারের দোকানে অভিযান চালিয়ে ল্যাপটপ ও মোবাইল জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে বেশ কিছু নথিপত্রও জব্দ করা হয়েছে।
নুসরাত হত্যা মামলার তিন নম্বর আসামি শামীমকে গত ১২ এপ্রিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৪ এপ্রিল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয় শামীম। তার জবানবন্দি যাচাই করার জন্য ২৫ এপ্রিল একই আদালতে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পিবিআই। বিচারক তিন দিনের মঞ্জুর করেন।

Comment here