ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

নিজস্ব প্রতিবেদক :দেশে এবার ডেঙ্গু রোগ অন্যান্য বছরের তুলনায় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, রাজধানীতেই এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। কিন্তু এ বছর ঢাকার বাইরেও এটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। এমন তথ্য তুলে ধরে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের জেরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এদিকে, আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত যারা সুস্থ হয়েছেন, তারা একই ধরনের ডেঙ্গু দ্বারা পুনরায় আক্রান্ত হলে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। তবে ডেঙ্গুর ভিন্ন ধরন দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত রয়েছে- এ মর্মে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ জন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ সব সংস্থাকে এখন থেকেই এডিস মশা নিধনে জোরালো ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

চলতি এপ্রিলের মাঝামাঝি ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই এটি মোকাবিলায় পুরোদমে কাজ করতে গতকাল রবিবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ ও জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইবরাহিম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, কীটতত্ত্ববিদ ও মশা গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার প্রমুখ।

সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও বিস্তার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে সমসাময়িক অনেক দেশের চেয়ে আমরা ভালো আছি। তদুপরি আমরা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি।

মন্ত্রী অন্যান্য দেশের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত দুই মাসে সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৯৬২ জন, মালয়েশিয়ায় ১৭ হাজার ৩৮৮ জন, শ্রীলংকায় ১৪ হাজার ৯৮৯ জন, আর বাংলাদেশে গত তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৭৫ জন। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো আছে।

মন্ত্রী হযরত শাহজাহালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশার উৎপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বলেন, আপনারা নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করুন। না পারলে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা নিন।

সভায় ঢাকা মহানগরীর দুই সিটি করপোরেশন নিজেদের প্রস্তুতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত

রয়েছে। চলতি ২০২৩ সাল পর্যন্ত যতটুকু কীটনাশক প্রয়োজন, এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সেই পরিমাণ কীটনাশক সংগ্রহ করেছে। আমাদের কীটনাশক ও যন্ত্রপাতির সমস্যা নেই। তিনি বলেন, যেসব দেশ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল, সেসব দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেই সফলতা এসেছে। এ জন্য বৈশাখের শুরু থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত সিটি করপোরেশনকে ১০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিতে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) দায়ী করেছে। সেখানে খালের মাটি উত্তোলন না করে ভরাট করার জন্য জলাবদ্ধতা হয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, খালে পানি প্রবাহ বাড়াতে না পারলে যতই ওষুধ ছিটানো হোক কোনো কাজে আসবে না।

সভায় ডেঙ্গু নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা এ বছর ডেঙ্গু বাড়বে। তবে সামগ্রিকভাবে যদি মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা হলে আক্রান্তের হার কমে যাবে।

এ কর্মকর্তা বলেন, গতবার ঢাকায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই ডেন-৩ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। এবার তারা ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হলে তেমন কিছু হবে না। কিন্তু যদি ডেন-১, ২ বা ৪ দ্বারা আক্রান্ত হন সে ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি থেকে যাবে। এটি নিয়েই আমরা শঙ্কিত।

এ সময় ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রশ্ন করেন, তা হলে সারাংশ কি দাঁড়াল? এবার ডেঙ্গু বাড়বে? জবাবে ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা তেমন আশঙ্কাই করছি।

কীটতত্ত্ববিদ ও মশা গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, এবার ডেঙ্গু বাড়বে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর ঢেউ বেশি দেখা দেবে। বরিশালের মধ্যে বরগুনায় অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতি। পাশাপাশি কক্সবাজারেও ডেঙ্গুতে ভোগাবে।

তিনি বলেন, আগে ধারণা করা হতো পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস জন্মায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন ড্রেনের নোংরা পানিতেও এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। তা ছাড়া ভবনের নিচে গাড়ির পার্কিংয়ে বৃষ্টি ছাড়াও পানি জমে থাকায় সারাবছরই এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকাতে ২৬ প্রজাতির মশা রয়েছে। তবে ঢাকায় যে এডিস মশা পাওয়া যায় তার ৯৯ দশমিক ১৪ শতাংশ এডিস ইজিপ্টি আর শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ হচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার মধ্যে এডিস ইজিপ্টিকে শহরের মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত মশা বলা হয়। আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায় ও বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এই সময় বেড়ে যায়।

কোন মশায় কোন রোগ ছড়ায়: অ্যানোফিলিস মশায় ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস বহন করে এডিস মশা। আর ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস নামক রোগের বাহক কিউলেক্স মশা।

বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তখন এটিকে ঢাকা ফিবার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে ৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচাইতে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। এবছর প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ৩০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং দেশের ৬৪ টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাব মতে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ৬২ হাজার ৩২১ জন, আর মারা যায় ২৮১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে ঢাকা সিটিতে ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ এডিসের লার্ভা রয়েছে। ঢাকার বহুতল ভবনের ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনের ৩২ দশমিক ২৮ শতাংশতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে ফুলের টব এবং ট্রেতে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, প্লাস্টিক পাত্র ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, পানিবদ্ধ ফ্লোরের ১২ দশমিক ১ শতাংশ।

 

Comment here