মধ্যবিত্তরা কোথায় যাবে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
জাতীয়

মধ্যবিত্তরা কোথায় যাবে

সীমিত আয়ের মানুষ, যাদের প্রতিদিনের ব্যয় সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়, সেই মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ব্যয় আরও বেড়ে যাবে আসন্ন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়িত হলে। একেবারেই দরিদ্র ও সহায়-সম্বলহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে কিছু বরাদ্দ থাকলেও সেই বরাদ্দ তাদের কাছে যথাযথভাবে আদৌ পৌঁছবে কিনা, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে।

নীতির সুফল ভোগে বিলম্ব হলেও করের ছোবল কিন্তু ইতোমধ্যেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘাড়ে এসে পড়েছে। স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষের খরচ ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে। তবে এর আঁচ খুব একটা লাগবে না অপেক্ষাকৃত ধনীদের। প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদশালীদের করমুক্ত সম্পদসীমা বাড়ানো হয়েছে। তদুপরি ব্যবসায় ও শিল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে তারা পাবেন নগদ সহায়তা; করের ক্ষেত্রেও থাকছে ছাড়। সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এমনটিই মনে করছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিদেশি অনুদান ও ঋণ ছাড়া পুরো অর্থের জোগানদাতা জনগণ। অর্থ সংগ্রহে মূল হাতিয়ার ভ্যাট। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ আসবে মূলধন, মুনাফা ও আয়কর থেকে। আয়করের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ধনীদের ক্ষেত্রে নতুন কোনো খাতে কর বসানো হয়নি; বাড়ানো হয়নি বিদ্যমান করের হারও। কিন্তু যে শ্রেণির মানুষের দশ রকম চাহিদা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়, সেই শ্রেণির মানুষের সে সব চাহিদার খাতগুলোতে বাড়ানো হয়েছে কর। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাবে সরকারের কোষাগারে।

কর্মের প্রয়োজনে পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূর-দূরান্তে থাকেন নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। একেবারে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাদের কথা বলতে হয় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে। কিন্তু সেই কথার বলার খরচ বাড়ছে প্রস্তাবিত বাজেটে। মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ মোবাইল সিম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে বাড়তি এই শুল্ক দিতে হবে। উপরন্তু সিমের কর ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, মোবাইল অপারেটরগুলো এ টাকা গ্রাহকের পকেট থেকেই কাটবে।

বাজেটে বেশ কিছু সুখবর রয়েছে নিম্নআয়ের ও সহায়হীন মানুষদের। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও ভাতা বাড়ানো হয়েছে। তবে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কিনা, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আশার প্রতিফলন ঘটেনি। ভ্যাটের চাপ পড়বে এসব শ্রেণির ওপর। এ ছাড়াও নিত্যপণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছরই বাজেটের পরপর ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে বড় আঘাত পড়ে ছোটদের ওপর। এর পাশাপাশি বাড়িওয়ালাও বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন।

তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় যে সহায়তা দেওয়া হয়, এটা আদৌ তাদের কাছে পৌঁছায় কিনা, এ নিয়ে এত দিন যে সংশয় ছিল, এবারের বাজেটে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে মনে হয়। কারণ এসব সহায়তা ব্যাংকের মাধ্যমে তারা তুলতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া সরকারের যেসব কর্মসূচি রয়েছে তা যদি সঠিকভাবে তাদের কাছে পৌঁছে তা হলে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে তাদের। কর আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবার আগে করের জাল বিস্তৃত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রামাঞ্চলেও এখন অনেক লোক আছেন যারা কর দেওয়ার যোগ্য, কিন্তু সরকার তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেটের আকার প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সক্ষমতার ঘাটতির মাত্রাও। তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। আগামী অর্থবছরেও এ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সুবিধার চেয়ে বরং চাপে বেশি থাকবে। বাজেটে বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে উচ্চবিত্তদের। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে নিম্নবিত্তরা উপকৃত হবেন। তবে এর বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ বিগত দিনে এ সুবিধা যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই এটি পাওয়ার যোগ্য নন। আর যারা পাওয়ার যোগ্য, তাদের ৭০ শতাংশেরও বেশি এ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন যা একটি বড় সমস্যা। আগে এ সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।

ড. জাহিদ বলেন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ লাভবান হতো যদি কর্মসংস্থান ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পেত। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা রয়েছে বিনিয়োগের। বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। করপোরেট কর কমানো দরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি খাতে প্রণোদনা দেখা যায়নি। তিনি বলেন, সাধারণ কৃষক ও শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী সর্বাধিক চাপে আছে। এবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে ১০০ কোটি টাকা এবং ব্যবসার শুরু করতে আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইতোপূর্বেও এ ধরনের বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সহায়তার নামে লুটপাট হয়েছে। আর যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা রাজনৈতিক অনুসারীদের। ফলে উন্নয়ন দূরের কথা, রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়েছে এসব খাতে। কৃষকরা ধানের দাম নিয়ে সংকটে পড়েছেন। বিশেষ করে পর-পর দুই মৌসুমে উৎপাদিত ধান ও ভুট্টা বিক্রি করে চাষাবাদের খরচের টাকাই তুলতে পারেননি কৃষক। বাজেটের আগে কৃষকপ্রতি ৫ হাজার টাকা ভর্তুকি দেওয়ার দাবি জানান বিভিন্ন সংগঠন। কৃষকদের জন্য কিছুই রাখা হয়নি; রাখা হয়েছে পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট শিল্পপতিদের জন্য। রপ্তানি করলে তারা বাড়তি নগদ প্রণোদনা পাবেন।

বিশ্বব্যাংকের এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকায় অপরিবর্তিত আছে। আগে আড়াই কোটি টাকার সম্পদের মালিক সারচার্জ দিতেন। এখন তাদের সারচার্জ মাফ। যাদের ৩ কোটি টাকার সম্পদ আছে তারা দেবেন সারচার্জ। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে খোদ সমাজের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। গড়ে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা আয় করলে বছর শেষে কর দেওয়া লাগবে। অথচ এই ২০ হাজার টাকা আয় করে জীবনযাত্রা পরিচালনা করাই দুষ্কর। মানুষকে আয়করের ফাঁদে আটকাতে বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে লাগবে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন); যেমনÑ বিদ্যুতের সংযোগ নিতে। এভাবে তাদের ব্যয় বাড়াতে বাধ্য করার নীতিমালা রয়েছে এবারের বাজেটে।

অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল থাকলে এর সুফল সবাই পাবেন। রেমিটেন্সের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ লাভবান হবেন। তিনি বলেন, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেট করা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে সবাই এর সুফল পাবেন।

এই বাজেটের পর ছোট ফ্ল্যাট কিনতে গেলে খরচ বাড়বে। ১১০০ বর্গফুটের কম আয়তনের ফ্ল্যাটে ভ্যাট দেড় থেকে দুই শতাংশ করা হয়েছে। এতে ৫০ লাখ টাকার ফ্ল্যাটে অন্তত ২৫ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হবে। আবার নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, রিকন্ডিশন্ড গাড়িতেই ভরসা মধ্যবিত্তের। সেখানেও দুঃসংবাদ। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অবচয়ন সুবিধা কমিয়ে দেওয়ায় গাড়ির দাম বাড়বে।

দুঃসময়ের জন্য প্রায় সব মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারা সঞ্চয় করেন। ভরসা হিসেবে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বাজেটে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি শিগগিরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাবেন। আবার সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগও কমানো হয়েছে। এই সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ।

বাজেটে চাকরিজীবীদের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ আছে। তাদের কর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা সঠিকভাবে রিটার্ন দিয়েছেন কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকেই। প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানের কতজন রিটার্ন দিয়েছেন, তা না জানালে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করা হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকরিজীবীদের জন্য সদয় হওয়ার পরিবর্তে আরও কঠোর হলো এনবিআর। ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন অনেকেই। পুঁজিবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ তাদেরকে ধরা হচ্ছে না এমনকি ধরার কোন ঘোষণাও নেই। অন্যদিকে বেআইনিভাবে অর্জিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বাজেটে। কালো টাকা দিয়ে হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করা যাবে। কেনা যাবে প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থেকে প্রভাবশালীরা তাদের সুফল বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন খরচে পিষ্ট দিনআনি দিন খাই মানুষেরা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থরক্ষা বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের ভরসা যে সঞ্চয়পত্র, সেই সঞ্চয়পত্রের ওপর কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তা খাত। এটি সাধারণ আয়ের অবসরপ্রাপ্ত মানুষের শেষ অবলম্বন। এ ছাড়া মধ্যবিত্তের মধ্যে যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন, তারাও এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই সঞ্চয়পত্রে বর্ধিত করহার প্রত্যাহার করা উচিত। এ ছাড়া আমদানিকৃত দুধের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ দুধেই ভেজাল কিংবা জীবাণু রয়েছে। তদুপরি আমদানিকৃত দুধের ওপরও যদি বর্ধিত কর ধরা হয়, তা হলে শিশুদের কি হবে? তাই এ কর প্রত্যাহার করা উচিত।

Comment here