সাফারি পার্কে যা হচ্ছে - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
ঢাকাসমগ্র বাংলা

সাফারি পার্কে যা হচ্ছে

মোঃ হুমায়ূন কবির স্টাফ, রিপোর্টার  : গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও পার্কটি এখন নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের আস্তানায় পরিণত হচ্ছে। নানা অব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অযত্ন-অবহেলায় পার্কে মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক দুর্লভ প্রাণির।

পার্কটির ভাঙা-চোরা সড়কে দেখলেই চোখে পড়বে অব্যবস্থাপনার ছাপ। অনেক স্থানে প্রাণিদের জন্য নির্মিত নেটের বেষ্টনি ছিঁড়ে গেছে, চলে গেছে অনেক প্রাণি। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে ক্যাঙ্গারুর অস্তিত্ব। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ময়ূর বেষ্টনি থেকে উড়ে গেছে অনেক ময়ূর। চিকিৎসকের অবহেলায় মারা গেছে পার্কটির একমাত্র পুরুষ জিরাফটিও।

এমনই চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে প্রায় চার হাজার একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, লোকবলের অভাব আর আর্থিক সমস্যার কারণে পার্কটির আজ এ দশা।

সাফারি পার্কের একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত পার্কে পাঁচটি বাঘ মারা গেছে। গত ১২ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে পার্কের ভেতর বাঘের নির্ধারিত বেষ্টনীর নির্জন একটি জায়গায় তিন বছর বয়সী একটি বাঘকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায় কর্তৃপক্ষ। এর এক সপ্তাহ আগে জীবন্ত একটি গুঁইসাপ খেয়ে ফেলে স্ত্রী বাঘটি। ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া একটি বাঘ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পার্কে মারা যায়। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল তিন পায়ের একটি বাঘের মৃত্যু হয়। এর আগে আরও দুটি বাঘ মারা যায় পার্কের ভেতরে। বর্তমানে পার্কে বাঘ রয়েছে ১২টি।

এ ছাড়া পার্কের ক্যাঙ্গারু বেষ্টনীতে ক্যাঙ্গারুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী ক্যাঙ্গারু আনা হয়েছিল। প্রথম অবস্থায় এ দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল ক্যাঙ্গারু দম্পতি। দুই বছর পর ওই দম্পতির ঘরে একটি ক্যাঙ্গারু শাবক জন্ম নিলেও কিছুদিনের মধ্যেই সেটি মারা যায়। এর বছরখানেক পর ফের ওই ক্যাঙ্গারু দম্পতি আরও একটি বাচ্চার জন্ম দেয়।

২০১৭ সালের অক্টোবরে পার্কের একমাত্র পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ক্যাঙ্গারুটি মারা যায়। চলতি বছরের প্রথম দিকে অবশিষ্ট মাদি ক্যাঙ্গারু দুটিও মারা যায়। ক্যাঙ্গারুর সেই বেষ্টনীতে এখন কয়েকটি হরিণ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অরিক্স, জিরাফ ও ব্লাক ওয়াইল্ড বিস্টও সঙ্গীবিহীন হয়ে পড়েছে। পার্কে আটটি অরিক্স আনা হলেও বর্তমানে আছে একটি মাদি অরিক্স। ১২টি জিরাফের মধ্যে টিকে আছে পাঁচটি মাদি জিরাফ। অরিক্স ও জিরাফ পরিবারে এখন কোনো পুরুষ সদস্য নেই। ছয়টি ব্লাক ওয়াইল্ড বিস্ট আনা হয়েছিল। বর্তমানে টিকে আছে একটিমাত্র পুরুষ ব্লাক ওয়াইল্ড বিস্ট। পার্কের দুই কর্মকর্তার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে চিকিৎসকের অবহেলায় চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি একমাত্র পুরুষ জিরাফটিও মারা যায়।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শেয়াল-কুকুরের পেটে গেছে ব্ল্যাক সোয়াইনের মতো প্রাণিও। গত বছরের ৭ ও ৯ নভেম্বর নির্ধারিত বেষ্টনী থেকে তিনটি ব্ল্যাক সোয়ান শেয়াল কিংবা বনবিড়াল খেয়ে ফেলে। পরবর্তী সময় পাশের বনে সেগুলোর দেহাবশেষ পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্তত ১০টি জেব্রা, ১০-১২টি হরিণ মারা গেছে গত কয়েক বছরে। কুকুরের আক্রমণে একটি চিত্রাহরিণেরও মৃত্যু হয়েছে।

ময়ূর বেষ্টনীর দৃশ্য যেন আরও করুণ। বেষ্টনীর বিভিন্ন স্থানে ছিঁড়ে গেছে নেট, লোকালয়ে চলে গেছে কয়েকটি ময়ূর। বছরখানেক আগেও শত ময়ূরের কেকা ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠত ময়ূর বেষ্টনীটি। তবে ময়ূর বেষ্টনীর ওপরের অংশ নেটবিহীন পড়ে আছে। যখন-তখন ময়ূরগুলো উড়ে গিয়ে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। লোকালয়ে চলে গেছে অনেক ময়ূর।

এদিকে, পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের অভিযোগ, পার্কে নানা অব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সময়ে এখানে এসে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আর কোর সাফারি পার্কের ভেতরে অনেক সময় বাঘ ও সিংহের দেখাই মেলে না। দেখা মেলেনা জিরাফের। অবহেলা আর অযত্নে কোর সাফারির ভেতর যেন আগাছায় ঢেকে আছে। বাঘ ও সিংহ ঝোপঝাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে।

ফলে দর্শনার্থীরা ১০০ টাকায় টিকিট কেটেও এদের দেখা পায় না। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় গাড়ি সঙ্কট, টিকিটের দাম নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে তাদের। খাবারের দাম ন্যায্য মূল্যের বেশি রাখা, হয়রানির অভিযোগও রয়েছে দর্শনার্থীদের।

পার্কে প্রকৃতি বীক্ষণ নামে যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। ফলে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত অসাধারণ এই প্রকৃতি বীক্ষণ দর্শন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পর্যটকরা। এ ছাড়া অনেক অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ অর্ধেক করে ফেলে রাখা হয়েছে।

পার্কের দায়িত্বে থাকা সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, পার্কের চারদিকে প্রাচীর রয়েছে। এ কারণে ময়ূর চলে যাওয়ার কোনো উপায় নাই। কিছু জায়গায় প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবিবুর রহমান জানান, ২০১৩ সালে পার্কটি প্রতিষ্ঠার পর মেইনটেন্সের কাজ তেমন হয় নাই। এখন অনেকগুলো কাজ শুরু করা হয়েছে। ময়ূর বেস্টনি, বাঘের শেড, সিংহের শেড নির্মাণসহ বেশ কিছু শেড নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে, অনেকগুলো টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আছে। এ বিষয়ে সরকার আন্তরিক এবং আগামী ৬ মাসের মধ্যে ছোটখাট যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কাজের ক্ষেত্রে লোকবল একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে তবিবুর রহমান বলেন, পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্তত আরও লোকবল প্রয়োজন। অথচ মাত্র ২৮ জন দিয়ে চলছে বিশাল পার্কটি। এ ছাড়া ৩০ জন জনবলকে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়।

সহকারী বন সংরক্ষক বলেন, চিকিৎসক থাকার কথা পাঁচজন, রয়েছেন মাত্র একজন। এসব সমস্যা সমাধানে আমরা কর্তৃপক্ষকে বলেছি। এ ছাড়া নিয়োগ বিধি নিয়ে একটি সমস্যা আছে, সেটি সমাধান হলে আমরা আরও জনবল পাব বলে আশা করছি। চলতি বছরেও এ পার্ক থেকে সরকার প্রায় ১০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ৫ হাজার প্রাণির খাবারের ব্যয় বহন করা হচ্ছে। প্রতি বছর অন্তত ৩ কোটি টাকা খাবার বাবদ খরচ করতে হয়।

Comment here