হামলাকারীরাই গায়েব করেছে ফুটেজ - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
শিক্ষাঙ্গন

হামলাকারীরাই গায়েব করেছে ফুটেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর ভবনটিতে ৯টি সিসি ক্যামেরা থাকলেও ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলার সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এসব ফুটেজ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বলছে, ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েবকা-ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার করলেই জানা যাবে ফুটেজ কে কীভাবে নিয়ে গেছে, কোথায় রেখেছে। পরিষদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীরও এতে মদদ রয়েছে। শুধু তাই নয়, গত রবিবারের ন্যক্করজনক এ হামলা চলাকালেও প্রক্টর নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছে পরিষদ। আর

এসব অভিযোগে সংগঠনটি প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সামনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ এ দাবি জানায়।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল বলেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নুর ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হামলাকারীদের মধ্যে কেউ-ই পার পাবে না। সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। একই দিন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম রাজধানীর একটি চার্চ পরিদর্শনের পর সাংবাদিকরা নুরের ওপর হামলার প্রসঙ্গ তোলেন। এ সময় ডিএমপি কমিশনার বলেন, নুর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নুর ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলার সময় সেখানে অনেককেই মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, মারমুখী অবস্থায় থাকা আর মারামারিতে অংশ নেওয়া এক কথা নয়। মামলা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে গ্রেপ্তার করা হবে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ সময় তিনি আরও জানান, গায়েব হওয়া সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে নুরদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলাটির তদন্তভার গতকাল শাহবাগ থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ডাকসু ভবনে ভিপির কক্ষে প্রবেশ করে নুর ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলার ঘটনা ডাকসু ভবনের ৯টি সিসি ক্যামেরাতেই ভিডিও হয়ে যায়। ওই ফুটেজই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য-প্রমাণ। যে কারণে মারধরের পরপরই সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ কম্পিউটরের হার্ডডিস্ক, মনিটর ও সিপিইউ খুলে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। পুলিশের তদন্তেও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসছে। যদিও এ ব্যাপারে এখনই মুখ খুলতে নারাজ পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঘটনার সময় ডাকসুতে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভিপি নুুর ও তার সহযোগীরা মার খেয়ে আহত হওয়ার পরও ভিপির রুমেই ছিলেন। আহত অবস্থায় প্রক্টর স্যার তাদের একে একে ভবন থেকে বের করে ঢামেক হাসপাতালে পাঠান। তাদের পক্ষে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নেওয়া সম্ভব না।

শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান গতকাল বুধবার আমাদের সময়কে বলেন, গতকাল পর্যন্ত তারা গায়েব হওয়া ফুটেজ উদ্ধার করতে পারেনি। কারা নিয়ে গেছে এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলতে পারেননি এ পুলিশ কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশে চলে গেছে বলেও জানান তিনি।

ওদিকে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, দপ্তর সম্পাদক মেহেদি হাসান শান্ত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্যকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ফুটেজের বিষয়ে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আল মামুন ছাত্রলীগের গত কমিটিতে কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপসম্পাদক ছিলেন। ইয়াসির আরাফাত ঢাবি ছাত্রলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নতুন সভাপতি-সম্পাদক

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করতে সংগঠনটির একাংশের নেতৃত্বে রদবদল হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকালে এসএম জাকারিয়া ইসলামকে মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ইফতেখারুল আলম রিশাদকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। ভিপি নুরের ওপর হামলার মামলায় আসামি হয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বর্তমানে পলাতক আছেন। আল মামুনও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে। নুরের করা অভিযোগে তারা দুজনই আসামি। এমন পরিস্থিতিতে জাকারিয়া ও ইফতেখারুল মঞ্চের নেতৃত্বে এলেন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম জাকারিয়া ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক উভয়েই এতদিন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ছাড়া জাকারিয়া মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আর ইফতেখারুল মাদারীপুর জেলা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। মঞ্চের এই অংশটির কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কমিটিতে রদবদলের বিষয়টি জানিয়েছেন।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালের সামনে গতকাল সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের অবস্থা তুলে ধরা হয়। পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, তুহিন ফারাবী আইসিইউতে ছিল। তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু আজ (গতকাল) আবার তাকে এইচডিইউতে নেওয়া হয়েছে। মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য এবং দেশবাসীকে দেখানোর জন্য তাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছিল। সোহেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে রাতে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তার মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল। অস্ত্রোপচার না করলে তার অবস্থা আরও সঙ্গিন হতে পারত। এ ছাড়া আরিফুল ইসলামের চোখে আঘাত রয়েছে। এখনো ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। আর নুরের ছোট ভাই আমিনুর সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের পক্ষে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করা হয়। এ প্রসঙ্গে রাশেদ খান বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করা হলেই স্পষ্ট হয়ে যেত হামলায় কারা কারা জড়িত ছিল। কিন্তু প্রক্টর গোলাম রাব্বানীর মদদে সিসিটিভি ফুটেজ সরানো হয়েছে। অথচ হামলার সময় পাঁচবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তিনি ফোন রিসিভ করে গালাগালি শুরু করেন। হামলার শুরুতেই যদি তিনি এসে ব্যবস্থা নিতেন, তা হলে এমন নির্মম হামলার শিকার হতে হতো না। কাজেই আমরা এ দালাল দলকানা প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করছি।

ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে রাশেদ খান বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বাহাউদ্দিন নাছিম হাসপাতালে এসে বলেছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের আটক করা হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি, মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন নেতাকেই শুধু গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনজিত ও সাদ্দামকে এখনো আটক করা হয়নি। অথচ আমাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে, তাতে হামলায় সনজিত ও সাদ্দামের অংশগ্রহণ আছে। আমরা সেটি প্রকাশ করেছি। কিন্তু সনজিত-সাদ্দামকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তথ্য-প্রমাণ থাকলেও তাদের ধরা হচ্ছে না।

পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রবিবারের হামলায় আহত মশিউর রহমান বলেন, সনজিত ও সাদ্দামের নির্দেশে ছাত্রলীগকর্মীরা লাইট বন্ধ করে আমাদের ওপর হামলা করে। অথচ এ পর্যন্ত মূল এ দুই হোতাকে আটক করা হয়নি। হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে এ হামলা হতো না। মশিউর আরও বলেন, ছাত্রলীগের পদবিধারীরাই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নামে আমাদের ওপর হামলা করছে, যেন ছাত্রলীগের নাম না জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ প্রকৃতপক্ষে একই সংগঠন।

এক প্রশ্নের জবাবে মশিউর বলেন, আমরা জানতাম না পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। আর ভিপি নুরসহ আমাদের সহযোদ্ধারা সবাই আহত ছিলেন। আগে তো জীবন বাঁচাতে হবে। তার পরই না আইনের আশ্রয়। তবে আমরা গতকাল থানায় অভিযোগ দিয়েছি। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের মামলার সঙ্গে এ অভিযোগ সংযুক্ত করবে। কিন্তু আমরা চাই, আমাদের অভিযোগটি আলাদাভাবে মামলা হিসেবে দায়ের হোক।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাবি প্রক্টরের পদত্যাগ ছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার, আহতদের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানানো হয়।

অভিযোগের বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, নুরের ওপর হামলার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত করে দেখছে। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে কিছু বলব না। তার পদত্যাগের যে দাবি তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

Comment here