এক ফ্লোরেই অঙ্গার ৪৯ জন, অধিকাংশ শিশু - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
সারাদেশ

এক ফ্লোরেই অঙ্গার ৪৯ জন, অধিকাংশ শিশু

ইউসুফ সোহেল,ঢাকা; আবু সাউদ মাসুদ,নারায়ণগঞ্জ ও সহিদুল করিম বিপ্লব,রূপগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৪৯ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে কারখানার চতুর্থ তলা থেকে পুড়ে অঙ্গার মরদেহগুলো উদ্ধার করে একে একে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জনে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা ও কারখানার শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কারখানা ভবনটির চতুর্থ তলায় কেচিগেট তালাবদ্ধ রাখায় ওই তলার শ্রমিকরা বের হতে পারেননি।
বিপুল প্রাণহানির ঘটনায় শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, কারখানায় কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে বলে মন্তব্য করেছেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাশেম। গতকাল তিনি বলেন, জীবনে বড় ভুল করেছি ইন্ডাস্ট্রি করে। ইন্ডাস্ট্রি করলে শ্রমিক থাকবে। শ্রমিক থাকলে কাজ হবে। কারখানায় কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে। এর দায় কি আমার? আমি তো কারখানায় গিয়ে আগুন লাগাইনি। অথবা আমার কোনো ম্যানেজার আগুন লাগায়নি। শ্রমিকদের অবহেলার কারণেও আগুন লাগতে পারে অথবা কোনো শ্রমিক সিগারেট খেয়ে ফেলে দিয়েছে। আবুল হাশেম বলেন, আমি ঘটনাস্থলে যাইনি, তবে আমার লোকজন সেখানে আছে। যারা মারা গেছেন, তারা তো আমারই ছেলেমেয়ে। আমি খুব ভেঙে পড়েছি। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমার ছেলেমেয়েদের পাশে থাকতে। এটা একটা দুর্ঘটনা। ফ্যাক্টরির সবগুলো ইউনিট চালু ছিল না। লোকজন কম ছিল। তার পরও যারা ছিল, তারা সবাই চেষ্টা করেছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিন্তু পারেনি। ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রূপগঞ্জের কর্ণগোপে হাশেম ফুডের সেজান জুস কারখানায় আগুন লাগে। সেই আগুন গতকাল দুপুরের দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনার রাতেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হন স্বপ্না রানী, মিনা ও মোরসালিন নামে তিন শ্রমিক। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে গতকাল কারখানা ও ঢামেকের মর্গের সামনে ছবি হাতে ভিড় করেন অনেকেই। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। লাশগুলো এতটাই পুড়ে গেছে যে দেখে চেনা বা শনাক্ত করার উপায়ও নেই। এই ৪৯ মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য গতকাল নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
দুর্ঘটনার জন্য মালিকপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা। তারা বলছেন, ভবনের নিচে ও ওপরে লোহার গেট তালাবদ্ধ থাকায় পুড়ে মরতে হয়েছে শ্রমিকদের। ভয়াবহ ওই ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকা- আখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের অভিযোগ, বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করায় পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে। ওই কারখানার শ্রমিক বিশাখা রানী বলেন, বেতন-ভাতা ও ওভারটাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই কারখানা মালিকপক্ষ এই ভবনে আগুন লাগিয়ে শ্রমিকদের হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চারতলায় আটকে রেখে হত্যা করে।
শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা জানান, কারখানাটিতে বেশিরভাগই শিশুশ্রমিক কাজ করত। শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও ঠিকমতো দেওয়া হতো না। বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি-ধমকি দেয়। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট বন্ধ রাখা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী রফিকুল ইসলাম জানান, ওই ভবনের কারখানায় ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। ভবনটি সেন্ট্রাল গোডাউন হিসেবে তারা ব্যবহার করতেন। ভবনে বিভিন্ন জুসের ফ্লেভার, রোল, ফয়েল প্যাকেটসহ বিভিন্ন মাল ছিল। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে দাবি করেন তিনি। কারখানাটির শ্রমিকরা জানান, কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। ছয়তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচতলার একটি ফ্লোরে কার্টন ও পলিথিন তৈরির কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত ঘটে। চারতলায় ৭০-৮০ জন শ্রমিক কাজ করেন। অগ্নিকা-ের খবরে চারতলার শ্রমিকরা ছোটাছুটি শুরু করলে ওই তলার নিরাপত্তারক্ষীরা কেচিগেটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে- আশ্বাস দিয়ে শ্রমিকদের বসিয়ে রাখেন। অগ্নিকা-ের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা বের হতে পারলেও চারতলার কেউ বের হতে পারেনি।
এদিকে, আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানাসহ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অর্ধশতাধিক গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। তারা হাশেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে অস্ত্রাগার থেকে তিনটি শটগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গতকাল পৃথক তদন্ত কমিটি করেছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিসও। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে জিল্লুর রহমান গতকাল জানান, কারখানাটিতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম ছিল না, জরুরি বের হওয়ার প্রয়োজনীয়সংখ্যক পথও রাখা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, আমরা গাড়ির মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা বাঁচাতে পারতাম। ছয়তলা ভবনের ছাদে ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছে, যার একটির ছাদের দরজা বন্ধ ছিল। ওই কারখানায় কেমিক্যালসহ প্রচুর দাহ্যপদার্থ ছিল। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে শুক্রবার দুপুরের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি বলেন, একেকটি ফ্লোর ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিটের। সিঁড়ি মাত্র দুটি। সিঁড়িতেও আগুন ছিল, ফলে অনেকে বের হতে পারেনি। চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল। নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন। উনারা নিচের দিকেও আসতে পারেননি, ছাদেও যেতে পারেননি। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিস্ফোরক পরিদর্শক আব্দুর রবের নেতৃত্বে একটি টিম প্রাথমিক পরিদর্শন শেষে জানিয়েছে কারখানা ভবনটিতে কেমিক্যাল গুদাম ব্যবহারে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান বলেন, কারখানাটিতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনাস্থলে স্থানীয় সাংসদ পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, কারখানার অব্যবস্থাপনার কারণে এ ঘটনা ঘটে থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকা-ের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারখানার মালিকপক্ষের বরাত দিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, কারখানাটিতে ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৫১ শ্রমিক নিখোঁজের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

Comment here