নির্দোষ প্রমাণে মরিয়া তাসভির,দায় এড়াচ্ছেন ফারুক - দৈনিক মুক্ত আওয়াজ
My title
জাতীয়

নির্দোষ প্রমাণে মরিয়া তাসভির,দায় এড়াচ্ছেন ফারুক

বনানীর এফআর (ফারুক-রূপায়ণ) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের দায়ের করা মামলার আসামি তাসভির উল ইসলাম ও প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুক হোসেনের ৭ দিন রিমান্ডের ২ দিন গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তারা ভবন নির্মাণ ও ফ্লোর ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানা ব্যত্যয়ের কথা জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তবে এই ব্যাত্যয়ে ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও রাজউকের ওপর দায় চাপিয়ে তারা কৌশলে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

তাসভির ভবনটির বর্ধিত অংশের মালিক ও ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুক হোসেন। মামলার অন্যতম আসামি ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুুুুুকুলকে পুলিশ ৩ দিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। দুর্ঘটনার পর গত ২৯ মার্চ দুপুরে রূপায়ণের মালিক মুকুল দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বনানীর এফআর টাওয়ার গতকাল পরিদর্শন করেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি, আইইবি এবং বুয়েটের প্রতিনিধি দলও সোমবার ভবনটি পরিদর্শন করে আলামত, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। পূর্ত ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিসের কমিটিও এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করে গতকাল। ভবনটির মালিকপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া নকশার সঙ্গে বাস্তবে কতটুকু সামঞ্জস্য আছে, অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের মতো আপৎকালীন ভবন থেকে বহির্গমনের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা খতিয়ে দেখেছে পৃথক তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

গতকাল সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত এফআর টাওয়ারের কাচ ও পোড়া এসির ভগ্নাংশ ভবনটির সামনের রাস্তায় ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এতে নতুন কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশ ওই রাস্তায় সব ধরনের গাড়ি চলাচল শুধু বন্ধই রাখেনি, ভবনটির সামনে সাধারণ মানুষদের কাউকেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না। সকাল থেকেই সিটি করপোরেশনের কর্মীরা দড়ি দিয়ে ভবনটির সামনে ও পেছনের দুপাশ আটকে রাখে। তবে ভবনের আরেক পাশের সড়ক দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়। পথচারী ও গাড়ি চলাচলে ভবনটির সামনে ও পেছনের ফুটপাত এবং রাস্তায় পুলিশের উদ্যোগে লোহার দণ্ড ও টিন দিয়ে ছাউনি তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন শ্রমিকরা। তবে ভবনের ভেতর থেকে আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজ করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের।

এদিকে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের পর আতঙ্কিত হয়ে এফআর টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরের অফিস সরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। গতকাল ভবন থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তারা জানিয়েছেন, ভবনটি কমপক্ষে তিন মাস ব্যবহার করা যাবে না মর্মে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই অন্য স্থানে তারা অফিস সরিয়ে নিচ্ছেন।

তারা এ-ও বলেছেন, আগুন লাগার সময় ভবনে কোনো ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি। যার কারণে আগুন লাগলেও প্রথম দিকে অনেকেই তা জানতে পারেননি। না জানার কারণেই সময়মতো অনেকেই ভবন ছেড়ে বের হতে পারেননি। আর এ জন্যই আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বলেন, রাজউক কোন বিধিমালায় বনানীর লাগোয়া ভবনগুলো নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। বনানীর ১৭ নম্বর রোডে এফআর টাওয়ারের পাশে ১০টি ভবন একেবারে লাগোয়া। এভাবে গায়ে গা লাগিয়ে ভবন নির্মাণের আইন নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

১৯৫৩-’৬৪-’৮৪-’৯৬-’০৬-’০৭-’০৮-এর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বিশাল পার্থক্য আছে। ১৯৮৪ সালের বিধিমালায় বলা ছিল- বাণিজ্যিক ভবন গায়ে-গায়ে লেগে স্থাপন করা যাবে; কিন্তু ’৯৬-এর নীতিতে স্পেস রাখতে বলা হয়। এখানে ভবনগুলো নির্মাণে কোন আইন মানা হয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে এসেছি মালিকপক্ষ আমাদের কাছে যে নকশা দিয়েছে আর রাজউকে যে নকশা আছে- এই দুইয়ের সামঞ্জস্য আছে কিনা। দ্বিতীয়ত, অনুমোদিত নকশার সঙ্গে এ ভবনের মিল আছে কিনা। মালিকপক্ষ থেকে যে নকশার কথা বলা হয়েছে আর রাজউক থেকে যে নকশার কথা বলা হয়েছে, পাশাপাশি এই দুটি নকশা দেখার পর আমরা বলতে পারব কোনটা সঠিক। রাজউকের নকশা আমরা এখনো হাতে পাইনি। পেলে দুই নকশা মিলিয়ে দেখব, কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা। আমরা রবিবার প্রথম কর্মদিবসে রাজউকের কাছে তথ্য চেয়েছি। তা পেলে কী ব্যত্যয় আছে তা জানতে পারব।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সহকারী সাধারণ সম্পাদক কাজী খাইরুল বাশিরের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি দল গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এফআর টাওয়ারে প্রবেশ করে। ভবনটি তিন ঘণ্টা ধরে পরিদর্শন শেষে ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে কাজী খাইরুল বাশির বলেন, আট থেকে দশতলা মেইন ইস্যু। এখানে কয়েকটি জায়গা আগুনের উৎস হতে পারে। এয়ারকন্ডিশন বা অন্য শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। আমরা এগুলো নিয়ে আলাপ করছি। দরকার হলে আবার পরিদর্শনে আসব।

ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি মুহূর্তে নির্গমন সুবিধা থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু জায়গায় তো কমতি ছিলই। এসব বিষয়ে ৪ এপ্রিল আলোচনা হবে। এর পর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এখনই চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করার সময় হয়নি।

রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে বনানীর এফআর টাওয়ার কীভাবে ২২ তলা হয়ে উঠল, সেই প্রশ্নের উত্তরে রিমান্ডে জমির মালিক ফারুক দাবি করেছেন, এফআর টাওয়ারের ৪৫ শতাংশের মালিকানা তার। বাকি অংশ রূপায়ণের। তার অমতেই ভবনটি অবৈধভাবে ২২ তলা গড়ে তোলা হয়েছে। তাই নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত ওই বর্ধিত অংশের দায়ভার তিনি নেবেন না। কারণ ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের পর ডেভেলপার কোম্পানি আরও চারটি ফ্লোর নির্মাণ করতে গেলে বাধা দিয়েছিলেন। বর্ধিত অংশ নিয়ে তিনি মামলাও করেন। এ নিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের সঙ্গে তার মনোমালিন্য চলছিল।

ফারুক জানান, ভবনের নকশা দেখিয়ে তিনি ঋণের আবেদন করেন; কিন্তু ভবনের নকশা ঠিক না থাকায় ব্যাংক ঋণ নামঞ্জুর করে। রূপায়ণ নিজেদের মালিকানাধীন একটি বাদে বাকি সব ফ্লোর বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ফারুক তার মালিকানাধীন অংশ ভাড়া দেন। যদিও অবৈধ চারটি ফ্লোরের মধ্যে ১৯ তলার মালিকানা ফারুককেই দিয়েছে ডেভেলপার কোম্পানি।

অবৈধ অংশ নির্মাণে অনিয়ম জানা সত্ত্বেও ওই অংশের একটি ফ্লোরের মালিকানা গ্রহণ প্রসঙ্গে ফারুক বলেন, কোনোভাবেই ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরেই ‘নাই মামার থেকে কানা মামা পাওয়া’র মতো কাজটি করেন তিনি। মালিকানা নিয়ে জটিলতার কারণে এফআর টাওয়ারের নিরাপত্তাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধানে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা ছিল জানিয়ে ফারুক বলেছেন, বিষয়টি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত।

রিমান্ডে এফআর টাওয়ারের বর্ধিতাংশের মালিক তাসভির জানিয়েছেন, ২০-২২ তলা পর্যন্ত তিনটি ফ্লোর তার। এ ফ্লোরগুলো করার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। অনুমোদনের সেই নথি দেখেই তিনটি ফ্লোর কিনেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত ওই তিন ফ্লোরের কাগজপত্র মালিকপক্ষ তাকে বুঝিয়ে দেয়নি; কিন্তু ওই তিন ফ্লোরের মালিকানার তথ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাসভির। জমির মালিক ঋণ না পেলে তাসভির কীভাবে একই ভবনের কাগজপত্র দিয়ে ঋণ পেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজছেন তদন্তসংশ্নিষ্টরা।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন জানান, এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় মামলার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তে রাজউক, মালিকপক্ষ এবং ডেভেলপার কোম্পানির মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গাফিলতি ও অপরাধ চিহ্নিত করে যার যার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ মিলবে, সবার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

গত বৃহস্পতিবার এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের মোট ১৩০ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। অন্যদের রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ১২ জনের মধ্যে দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) সোহেল রানা এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রেজওয়ান আহমেদ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, রেজওয়ানের আঘাত অত্যন্ত গুরুতর। ভবন থেকে পড়ে গিয়ে তিনি আহত হন। এতে তার হাত-পা ভেঙে গেছে। শরীরের অন্য অংশও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভর্তির পরপরই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

Comment here